কয়েকটা সেকেন্ড নিশ্চুপ হয়ে গেল চারপাশ, সবাই হাঁ করে দেখছে মারামারি। তারপর যা শুরু হলো তা কহতব্য নয়। স্রেফ নরক ভেঙে পড়ল কনফারেন্স রুমে। সিরিয়ান আর লেবানিজদের সাথে ইসরায়েলিদের ভয়ানক হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। অন্যান্য ডেলিগেটরাও দাঁড়িয়ে যা ইচ্ছে তাই গালাগালি শুরু করে দিল। সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে, স্টিভেনসন ছাড়া। বসে বসে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছেন তিনি হতাশ ভঙ্গিতে।
রাশানরা তাড়াতাড়ি কাগজপত্র নিয়ে কেটে পড়ল, তাদের পিছু পিছু গেল ইউ.এস সেক্রেটারি অভ স্টেট এবং ফ্রেডরিক আর্থার। বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে শুনল কে একজন ইংরেজীতে ওদের থামতে বলছে। কিন্তু কেউ থামল না।
.
আর্থার গাড়িতে উঠছে, শুনল রেডিওতে ইসরায়েলি-সিরিয়ানদের মারামারির খবর প্রচার শুরু হয়েছে। অফিসে পৌছার পর অসংখ্য ডিপ্লোম্যাটিক টেলেক্স আর ফোন পেল সে। তিন ঘণ্টা পর ডেস্ক ছেড়ে ওঠার ফুরসত মিলল। ততক্ষণে হাত ব্যথা হয়ে গেছে তার ফোন ধরে।
সেক্রেটারি বলল, ‘আপনার স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন মি. বুহেরের ডিনারে যাবেন কিনা।’
চোখ পিটপিট করল আর্থার। বুহেরের কোন দাওয়াতের খবর সে জানে না।
‘ডিনার, স্যার,’ ব্যাখ্যা করল মেয়েটা। ‘পেরিফোর্ডে। সাড়ে আটটার সময়। উনি বললেন আপনি ভুলে যেতে পারেন।’
আর্থার ধন্যবাদ দিল সেক্রেটারিকে।
‘উনি বলেছেন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে নাকি মি. বুহের এটাকে লাস্ট সাপার বলে অভিহিত করেছেন।’
‘রসিক জন,’ মন্তব্য করল আর্থার, তারপর হেসে উঠল দু’জনে একসাথে।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৮
আঠারো
অপরূপ সেজেছে শীলা। চোখ ফেরাতে পারছে না আর্থার। বিয়ের পর ছ’বছর হয়ে গেল, এখনও শীলাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে দেখলে অদ্ভুত কামনা অনুভব করে সে। এ মুহূর্তে, বিভিন্ন জায়গা থেকে টেলেক্স আসছে, টিভিতে খবর হচ্ছে, সব ভুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে আর্থার। শীলা একটা টুলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।
অনেক কষ্টে ওর ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে টিভির প্রতি নজর দিল আর্থার। সংবাদ পাঠক আসন্ন এক ঝড়ের কথা বলছে। ঝড় শুরু হতে যাচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। সিরিয়ানরা নেসেটের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে, রাশান অ্যামবাসাডরকে তুলে নেয়া হচ্ছে তেল আবিব থেকে। ডিপ্লোম্যাটিক টেলেক্সগুলোয় চোখ বুলাল আর্থার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
‘কি ঘটবে বলে তোমার ধারণা?’ উঠে দাঁড়াল শীলা, শরীরে ঢেউ তুলে ঘুরল, বড় বড় চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।
ঢোক গিলল আর্থার। শীলাকে এত আকর্ষণীয় এর আগে আর কখনও মনে হয়নি তার। ওর সাথে এক্ষুণি, এখানে প্রেম করার অদম্য বাসনা জাগল মনে।
‘অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না,’ শীলার দিকে এগিয়ে গেল আর্থার। কি ঘটবে ভালই জানা আছে তার। কিন্তু আসল কথা বলে ওকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না। স্ত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড়াল আর্থার। কিন্তু শীলার তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষতে শুরু করল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর্থার। ‘আবার বলো তো পল কবে আমাদের দাওয়াত দিয়েছে।’
‘গত হপ্তায়। বললামই তো। একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তোমাকে বলেওছিলাম। তুমি শুধু মুচকি হেসেছ।’
শ্রাগ করল আর্থার। ব্যাপারটা মনে পড়ছে না। তবে শীলা যখন বলছে তখন তা সত্যি হবারই কথা।
‘তুমি রেডি?’ বলল আর্থার। ‘আমি গাড়িতে গেলাম।’
জবাবে মাথা ঝাঁকাল শীলা।
ওর ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়ল আর্থার। ঘর থেকে বেরিয়েই ছুটল সিঁড়ির দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখল শীলা ওকে অনুসরণ করছে কিনা। স্টাডিতে ঢুকল আর্থার। ড্রয়ার খুলে হ্যাভারস্যাকটা বের করল। উল বোনার কাঁটার মত ড্যাগারের ডগা ফুটে আছে কাপড়ে। সদর দরজা খোলার আগে আবার তাকাল সিঁড়ির দিকে। স্যাঁতসেঁতে বাতাস ধাক্কা মারল নাকে। খুক খুক কাশল আর্থার। পুবাকাশ থেকে ভারী মেঘ ছুটে আসছে, কুকুরের মত বাতাসের গন্ধ শুঁকল ও। মনে পড়ে গেল বাবার কথা। বাবা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন বৃষ্টি হবে কিনা। বলতেন বজ্রপাতের শব্দটা আসলে কিছু না-ঈশ্বর তাঁর আসবাবপত্র সরানোর সময় অমন আওয়াজ হয়। আজ রাতে ঈশ্বর অনেক আসবাব সরাবেন, গম্ভীর হয়ে ভাবল আর্থার।
কাঁকর বিছানো রাস্তা ধরে এক ছুটে গ্যারেজে পৌঁছে গেল ও, দেখল না শীলা জানালার ফাঁক দিয়ে লক্ষ করছে ওকে।
গাড়ি স্টার্ট দিল আর্থার, হ্যাভারস্যাকটা চালান করল ড্রাইভিং সীটের নিচে 1 পোশাকের কোনা উঁচু করে ধরে ছুটতে ছুটতে এল শীলা। গাড়িতে ঢোকার আগ মুহূর্তে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল গায়ে।
নুয়ে দরজা খুলে দিল আর্থার, খেয়াল করল হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপ পেঁচিয়ে গেছে গিয়ার স্টিকের সাথে। দ্রুত প্যাঁচ খুলে ওটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল শীলা দেখে ফেলার আগে। ‘কি খুঁজছ?’ সীটে বসে জানতে চাইল শীলা।
‘কিছু না,’ আর্থার চুমু খেল ওর গালে। ‘তোমাকে দারুণ লাগছে।’
‘ধন্যবাদ,’ বলে আয়না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শীলা। বৃষ্টিতে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেল কিনা দেখার জন্যে।
নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল গাড়ি, ক্যাসেট প্লেয়ারে রিকি মার্টিনের গান বাজছে। রিকি শীলার প্রিয় গায়ক। ‘মারিয়া’ গানটার সুরে তাল মেলাতে লাগল সে। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল আর্থার। একটুও বাড়িয়ে বলেনি ও। সত্যি দারুণ লাগছে শীলাকে। ইচ্ছে করল ওকে জড়িয়ে ধরে রাখে শক্ত করে, কেউ যেন ওর ক্ষতি করতে না পারে।