দুলে উঠল আর্থার দেয়ালের ওপর, অদম্য ইচ্ছে হলো লাফিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে সমুদ্র ভ্রমণে, জাহাজের ডেকে দাঁড়ালে যেমন পানিতে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনি। চোখ বুজে ফেলল ও। ক্রুশের ওপর সেই শিশুর ছবিটা ভেসে উঠল সামনে।
মাথা ঝাঁকাল আর্থার, ছবিটাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে, নাক কুঁচকে উঠল
বোটকা একটা গন্ধে। কুকুরটার গা থেকে আসছে। ড্যাগারের বাঁট চেপে ধরল ও, ধরেই থাকল। যীশুর মুকুটের কাঁটাগুলো ফুটে গেল হাতের তালুতে। ব্যথাটা আবার সচেতন করে তুলল ওকে। চাইল চোখ মেলে। সাথে সাথে হ্যালুসিনেশন থেকে মুক্ত হলো আর্থার।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ও, তাকাল কুকুরটার দিকে। নড়ছে না ওটা, কটমট করে তাকিয়ে আছে আর্থারের দিকে। আর্থার দ্বিতীয়বার আর তাকাল না ওটার দিকে। দ্রুত এগোল দেয়ালের দূর প্রান্তে, নেমে পড়ল। হ্যাভারস্যাকটা কাঁধে ঝোলাচ্ছে, শুনতে পেল প্রলম্বিত একটা চিৎকার। ব্যর্থ আক্রোশে করুণ সুরে ডাকছে কুকুরটা।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৭
সতেরো
রবার্ট স্টিভেনসন জানালা দিয়ে তাকাতে লিমোজিনের প্রথম বহরটাকে দেখতে পেলেন। গাড়ি থেকে নামতেই প্রেস ফটোগ্রাফার আর টেলিভিশন ক্রুরা তাদেরকে মৌমাছির মত ছেঁকে ধরল। তৃপ্তির হাসি হাসলেন স্টিভেনসন। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছে। এরপর থেকে যা-ই ঘটুক না কেন, ইতিহাসে তার নাম যে স্থান পেতে চলেছে তা ধ্রুব সত্য। তিনি প্রায় একাই এই মীটিং-এর ব্যবস্থা করেছেন। ইসরায়েলিরা সিরিয়ান আর লেবানিজদের সাথে হাত মেলাতে যাচ্ছে। বিশেষ করে এমন এক লেবানিজের সাথে তারা হাত মেলাবে যার কিনা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-র সাথে সম্পর্ক রয়েছে। সকল পক্ষই কিছুটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছে, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দিতে চলেছেন ফরেন সেক্রেটারি।
এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক মত চলছে দেখে তিনি কল্পনার ফানুস ওড়ালেন; সাদাতের পর এই প্রথম ইসরায়েলি আর লেবানিজদের মাঝে সত্যিকার শান্তির সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। তবে যদি উল্টোটা ঘটে? ভাবতে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামতে লাগল। এদের প্রত্যেকের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে: লেবানিজ, সিরিয়ান, লিবিয়ান। যদিও কেউই স্বীকার করেনি ব্যাপারটা। কেউ বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করলে কেয়ামত শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, নিজেকে প্রশ্ন করলেন স্টিভেনসন, সমস্যা হবে এমনটি ভাবছেন কেন তিনি? চুক্তি তো তৈরি হয়েই গেছে, শুধু আকর্ষণীয়ভাবে ঘোষণার অপেক্ষা
কিংস চার্লস স্ট্রীট থেকে হোয়াইট হলের দিকে দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল স্টিভেনসনের। ইসরায়েলিরা আসছে। আবার চঞ্চল হয়ে উঠল সাংবাদিকরা। রাস্তার দু’পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। তবে কারও হাতে কোন ব্যানার নেই। মুচকি হাসলেন রবার্ট। লোকজন তাদের সন্তানদের বলতে পারবে ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদদের তারা এক দরজা দিয়ে ঢুকতে এবং বেরুতে দেখেছে। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে আন্দোলনেরও কোন ব্যানার চোখে পড়ল না। ট্রাফালগার স্কোয়ার ট্রাজেডি তাদেরকে নেতাশূন্য করে দিয়েছে। তারা এখনও শোক সামলে উঠতে পারেনি।
গভীর করে শ্বাস নিলেন রবার্ট স্টিভেনসন, আয়নায় নিজেকে দেখলেন একবার। তারপর পা বাড়ালেন সিঁড়ির দিকে। আর ষাট মিনিটের মধ্যে তিনি ভূষিত হতে চলেছেন বিশ্বের অন্যতম শান্তিরক্ষক হিসেবে…
.
কনফারেন্স রুমে, সেক্রেটারি অভ স্টেটের পেছনে গিয়ে বসল ফ্রেডরিক আর্থার।
প্রকাণ্ডদেহী লোকটা ঘুরে নড় করল ওকে। আর্থার মনে মনে প্রার্থনা করল সেক্রেটারি যেন তাকে জিজ্ঞেস না করে বসে সেদিন মীটিং-এ সে অনুপস্থিত ছিল কেন? রোম যাত্রার ব্যাখ্যা কি দেবে আর্থার?
শুরু হয়ে গেল মীটিং। সিরিয়ান এবং লেবানিজরা পাশাপাশি বসেছে, রাশানরা তাদের পেছনে। ওপেক-এর সদস্যরা এক সাথে বসেছে। ইসরায়েলিরা আসন নিয়েছে আমেরিকানদের ডান পাশে।
কয়েকজনের বক্তৃতা শেষ হবার পর রবার্ট স্টিভেনসন ঘোষণা করলেন, ‘এবার পূর্ব জেরুজালেমের বিতর্কিত এলাকা নিয়ে কথা বলতে আসছেন সিরিয়ান ডেলিগেট।’
একটা টেলিভিশন ক্যামেরা চট করে ঘুরে গেল দীর্ঘদেহী এক সিরিয়ানের দিকে। সে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল নোটের ওপর চোখ রেখে। মাতৃ ভাষায় বলতে শুরু করল সিরিয়ান। আর্থার হেডফোন লাগাল মাথায় অনুবাদ শোনার জন্যে। সিরিয়ানের বক্তৃতা শুনছে সবাই চুপচাপ। এক পর্যায়ে আরাফাতের প্রসঙ্গ তুলল সে। বলল, বুড়ো মানুষটাকে এ পর্যন্ত কতবার গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবু তিনি এখন পর্যন্ত সাহসের সাথে শক্তির বলগা ধরে আছেন।
কিংবদন্তীর পিএলও’র নেতার নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হিব্রু ভাষায় চিৎকার করে কি যেন বলল সে। আর্থার সহ সবাই তাকাল তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে।
দাঁড়িয়ে পড়লেন রবার্ট স্টিভেনসন, বক্সিং রেফারির মত হাত উঠে গেছে শূন্যে, মুখ থেকে সরে গেছে রক্ত।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাফ দিয়ে পড়ল নিজের টেবিলের ওপর দিয়ে, ছুটল সিরিয়ানকে লক্ষ্য করে। একজন তার পথ আটকে দাঁড়াতে চেয়েছিল, তবে দেরি হয়ে গেছে অনেক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি একটা ছুঁড়ে মেরেছে, আলো প্রতিফলিত হলো ওটার ওপর। ভারী একটা অ্যাশট্রে, ধাঁই করে লাগল সিরিয়ান ডেলিগেটের মুখে। আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা, দাঁত ভেঙে গেছে, রক্তে ভেসে গেল টেবিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাফিয়ে পড়ল তার ওপর, গালাগাল দিচ্ছে, তাকে সরিয়ে নেয়ার আগেই আবার আঘাত করে বসল সে।