রবার্ট স্টিভেনসন ফরেন সেক্রেটারি। খানিক আগে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন টিভিতে।
‘সেই গৎ বাঁধা বুলি,’ কাঁধ ঝাঁকাল বুহের।
‘মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাটা গৎ বাঁধাই,’ মন্তব্য করল মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
তারপর দু’জনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠল। মিনিট বিশেক পর আর্থার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল এবার তাকে উঠতে হবে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আবার হাত মেলাল ওরা।
‘লন্ডনে লম্বা সময়ের জন্যে এসেছেন?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।
‘নাহ্। স্রেফ ফ্লাইং ভিজিট। দেখতে এসেছি কর্মচারীরা কেমন কাজকর্ম করছে। শুক্রবার চলে যাব। ভাল কথা, শুনলাম সিনেটে দাঁড়াবার পরিকল্পনা করেছ।’
হাসল আর্থার। ‘এ ব্যাপারটা তো কারও জানার কথা নয়।’
‘ঠাট্টা রাখো। কাজটা ভালই করছ তুমি। হোয়াইট হাউজে যাবার সমস্ত যোগ্যতাই তোমার আছে।’
জবাবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল আর্থার। সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা তার রয়েছে।
‘ক্যাম্পেইনের জন্যে টাকা দরকার,’ বলল বুহের। ‘আর থর্ন কর্পোরেশনের টাকার অভাব নেই।’
‘জেনে খুশি হলাম, পল। তবে ব্যাপারটা স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? আমি ডেমোক্রাট। আর প্রেসিডেন্ট, যাঁকে আপনি সমর্থন দিচ্ছেন, তিনি রিপাবলিকান।’
‘প্রেসিডেন্ট দুর্বল মানুষ, বলল বুহের। ‘আশা করা হয়েছিল তিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবেন।’
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব হলো না।’
হাসল বুহের। ‘ওটা প্রশ্ন ছিল নাকি?’
দরজা খুলল আর্থার, পা রাখল চৌকাঠে।
‘কফির জন্যে ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।’
আর্থার চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে রইল বুহের। তারপর বন্ধ করল দরজা। আর্থার বেশ অদ্ভুত, অত্যন্ত চতুর একজন ডিপ্লোম্যাট, তার কোন শত্রু নেই, মানুষ হিসেবেও খুব সৎ। তবে তার সততা কখনও কখনও পাগলামির পর্যায়ে পৌছে যায়। এ ধরনের লোকদের নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তবে আর্থারের ব্যাপারে যাবতীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আগে করে রেখেছে পল বুহের। সে আর আর্থারকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না। ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে।
.
সবে সন্ধে নেমেছে। অক্সফোর্ড রোডের দিকে ছুটে চলেছে পল বুহেরের বিলাসবহুল লিমোজিন। সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে বুহের। ঝিমুচ্ছে। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ক্লান্ত লাগছে। কাজের যত চাপই থাক, তিন/চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিলেই সে চাঙা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ইদানীং একটু সমস্যা হচ্ছে মনে হচ্ছে। ডাক্তার দেখানো দরকার। ঝিমুতে ঝিমুতে নিজের জন্মদিনের কথা ভাবছিল পল বুহের। মনে পড়ছে বাবা বলত: ‘১৯৫০ সালের জুন মাসে তুমি কুড়িতে পা দেবে। আশা করব ততদিনে নিজস্ব স্বকীয়তা অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর ১৯৭০ সালের জুনের মধ্যে তোমাকে অর্জন করতে হবে অনেক অনেক কিছু।’
বাবার আশা পূরণ করেছে বুহের। থর্ন কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট যে সে-ই হতে যাচ্ছে এটা সূর্য পুব দিকে ওঠার মতই নিশ্চিত ছিল। সবাই চমৎকার পরিকল্পনা মাফিক চলছিল। মাঝখানে থর্ন রাজ্যের শেষ বংশধর ডেমিয়েন থর্নের আকস্মিক মৃত্যু তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। ডেমিয়েনের মৃত্যুর পরে আঠারো বছর চলে গেছে। এখনও তার মৃত্যুর কথা মনে পড়লে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে।
ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠে চোখ মেলল বুহের, দেখল রিয়ার ভিউমিরর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার। বুহের পকেট হাতড়ে ভিটামিন বড়ির শিশিটা বের করল, এক সাথে কয়েকটা মুখে পুরল। পেটের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। গুলিয়ে উঠতে চাইছে। এমন হয়। ছেলেটার সাথে দেখা করার সময় হলেই এমন পেট গোলাতে থাকে বুহেরের। আসলে টেনশনে এমনটা হচ্ছে। ছেলেটা সতেরোতে পা দিয়েছে, প্রাপ্ত বয়স্ক হতে চলেছে। শিষ্যরা বলেছে ছেলেটা নাকি লম্বা হয়েছে বেশ, গায়ে গতরে মাংসও লেগেছে।
ঢেকুর তুলল বুহের। পেট ব্যথাটাই তাকে মারবে। আর ছেলেটার সাথে দেখা হবার সময় হলেই পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায় তার। কোন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রতিপক্ষ এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিয়েও এতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয় পল বুহের। শুধু ছেলেটাই তার ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বুহের। পাকা রাস্তা ছেড়ে সরু, মেঠো পথ ধরেছে লিমোজিনের ড্রাইভার। রাস্তাটা পেরিফোর্ডের দিকে গেছে। তীক্ষ্ণ বাঁকগুলোতে সতর্কতার সাথে মোড় নিল ড্রাইভার। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপ, খরগোশ দৌড়ে পালাচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে ঝোপের আড়ালে। উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা খাচ্ছে উড়ন্ত পোকা, দু’একটা মরে আঠালো শরীর নিয়ে সেঁটে থাকল কাঁচে।
‘এসে গেছি, স্যার।’ ইন্টারকমে খড়খড় করে বেজে উঠল ড্রাইভারের গলা। গেটের বাইরে গাড়ি থামাল সে। ডেমিয়েনের মৃত্যুর পরে এখানে সিকিউরিটি সিস্টেম বসানো হয়েছে। জংধরা, বিশাল লোহার গেট বিদ্যুৎশক্তিতে খোলে, বন্ধ হয়। ড্রাইভার ড্যাশ বোর্ডের একটা বোতামে চাপ দিল, ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল গেট। ড্রাইভওয়ের আধা মাইল দূরে বিশাল প্রাসাদটার পশ্চিম উইং দেখা যাচ্ছে। ওখানে বুহেরের জন্যে সবচে’ দামী ব্রান্ডি অপেক্ষা করছে, ড্রইংরুমের ফায়ার প্লেসে জ্বলছে আগুন। বুহের এবার একটু আরাম করতে পারবে।