‘ধন্যবাদ,’ বলে উঠে দাঁড়াল সে, ইঙ্গিত করল ওদের ভেতরে আসতে।
সারিবদ্ধভাবে শৃঙ্খলার সাথে ভেতরে ঢুকল তারা। প্রথমে তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট জন্মদিনের অভিনন্দন জানাল পলকে, তারপর ডিপার্টমেন্টাল হেডের দল, সবশেষে এল কোম্পানি এক্সিকিউটিভরা। এদের চেহারাটাই শুধু চেনা পলের। নাম জানে না।
প্রত্যেকে সসম্ভ্রমে পল বুহেরের সাথে হাত মেলাল। হ্যান্ডশেক পর্ব শেষ হলে তরুণ এক ভৃত্য বয়ে নিয়ে এল মোমবাতি দিয়ে সাজানো, ইংরেজী ‘টি’ আকারের বিশাল এক কেক। নিঃশব্দে বুহেরের ডেস্কে কেকটা রেখে পিছিয়ে গেল সে। মৃদু হেসে তাকে ধন্যবাদ দিল বুহের। তিন বারের চেষ্টায় ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারল সব ক’টা মোমবাতি। কাজটা শেষ করে রীতিমত হাঁপাতে লাগল সে। সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করল তাকে। দোরগোড়ায় দেখা গেল ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছে এক ওয়েটার। 1
‘শ্যাম্পেন চলবে?’ জিজ্ঞেস করল সেক্রেটারি।
‘মন্দ কি!’ বলল বুহের।
শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে শুরু করল ওয়েটার। একটা গ্লাস নিয়ে স্মিত মুখে তার কর্মচারীদের স্তুতি শুনছে পল বুহের।
‘পল, বোঝাই যায় না আপনার বয়স হয়েছে।’
….আশা করি গত বছরের মত এ বছরটাও আপনি সাফল্যের সাথে পার করে দেবেন, স্যার,’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কর্মচারীদের সাথে হালকা মেজাজে কথা বলতে বলতে পল ভাবছিল এদের মধ্যে কে হতে পারবে তার যোগ্য উত্তরাধিকারী। কিন্তু কাউকেই তার মনে ধরছে না। শিকাগোর হেডকোয়ার্টারেরও একই দশা। এই বিশাল সাম্রাজ্য চালাতে তার দরকার আরেকজন চল্লিশ বছরের পল বুহের।
‘সত্তর বছর বয়সকে অভিনন্দন।’
ঘুরে দাঁড়াল পল। জন। মদ খেয়ে লাল হয়ে গেছে চেহারা, ওর দিকে গ্লাস তুলে দেখাচ্ছে।
বিরক্ত বোধ করল বুহের।
‘অভিনন্দন তিন কুড়ি দশকেও,’ মুচকে হাসল জন।
হঠাৎ কেন যেন কেঁপে উঠল বুহের, এক পা পিছিয়ে গেল। কোত্থেকে উদয় হলো তার সেক্রেটারি, সব ক’টা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে জনের হাত ধরে টান দিল। ‘আমি কি কিছু বলেছি?’ হতবুদ্ধি দেখাল জনকে।
‘ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও,’ মৃদু গলায় বলল বুহের। সেক্রেটারি টানতে টানতে জনকে নিয়ে চলল দরজার দিকে, সেই সাথে উপস্থিত অভ্যাগতরাও তার পেছন পেছন এগোল।
বুহের নিজের চেয়ারে এসে বসে পড়ল ধপ করে, চোখ বুজল। খানিকপর চোখ খুলে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার সেক্রেটারি।
‘সরি, স্যার…’
মাথা নাড়ল বুহের। ‘না, ঠিক আছে।’
‘আপনার কিছু লাগবে?’
‘আরও ত্রিশ বছর,’ বলল বুহের।
জবাবে কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু হাসল মেয়েটা। তারপর বেরিয়ে গেল দরজা বন্ধ করে।
.
ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে পল বুহের, এপাশ ওপাশ করছে, কি যেন বলছে বিড়বিড় করে। পাশে শোয়া মেয়েটা কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হলো, তাকাল পলের দিকে। আঙুল দিয়ে বুকে আঁকিবুকি কাটতে লাগল সে, ডানহাতটা ঝাঁকি খেল বুহেরের। হাতটা চেপে ধরল মেয়েটি, তালুতে সুড়সুড়ি দিল। কপালে ভাঁজ পড়ল বুহেরের, অস্পষ্ট গলায় কি বলল বোঝা গেল না।
হেসে উঠল মেয়েটা, কনিষ্ঠা আঙুলটা ধরে নাড়াতে লাগল। জন্মদাগ দেখা যাচ্ছে আঙুলের ডগায়। আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখতে অবিকল সংখ্যার মত: একদিক থেকে মনে হয় ইংরেজী তিনটে নয়, আবার অন্য অ্যাঙ্গেল দিয়ে তাকালে ঠিক তিনটে ছোট ছয়-এর মত লাগে।
মোচড় খেল বুহের, খালি হাতটা শূন্যে উঠে গেল, সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে। ঠোঁট নড়ছে ওর।
‘কি বলছ?’ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল মেয়েটা।
‘তিন কুড়ি এবং দশ,’ বিড়বিড় করছে বুহের।
‘শ্শ্শ্শ্শ্…’ শক্ত করে হাতটা চেপে ধরল মেয়েটা, ঘুমের মধ্যে বুহের এত জোরে চাপ দিল, রীতিমত ব্যথা পেল সে। খসখসে জন্মদাগে লাগছে খুব। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল সে, কিন্তু বুহের ধরেই থাকল।
‘পল,’ ককিয়ে উঠল মেয়েটা।
‘তিন কুড়ি এবং দশ,’ কর্কশ গলায় বলল বুহের। ‘আরমাগেড্ডন… কেয়ামতের বছর। সত্তর বছর।’
টান মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা, গড়ান দিয়ে সরে গেল বুহেরের পাশ থেকে। এখনও ঠোঁট নড়ছে ওর, তবে শব্দ হচ্ছে না। নিজের হাতের দিকে চাইল মেয়েটা। আঙুলে বুহেরের জন্মদাগের ছাপ পড়ে গেছে। জ্বলছে খুব। এক মুহূর্ত অসাড় বোধ করল সে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জন্মদাগের দিকে, তারপর মুখে পুরে নিল আঙুলটা, চুষতে লাগল। মুখ থেকে আঙুলটা বের করল সে, জিভের ডগা ছোয়াল খুদে তিনটা ছয়ের ওপরে, তারপর পাশ ফিরে শুলো, বুহেরের গালে চুমু খেল, বিড়বিড় করে কি যেন বলল। একটু পরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে। তৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ২
দুই
নিজের স্যুইটে বসে নাস্তা সারার পর খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে পল বুহের, এমনসময় বেজে উঠল ইন্টারকম।
‘অ্যামব্যাসাডর এসেছেন, স্যার।’
‘ওঁকে আসতে বলো,’ বলল বুহের।
প্রায় সাথে সাথে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ইউএস অ্যামব্যাসাডর ফ্রেডরিক আর্থার। মধ্য পঁয়তাল্লিশ চলছে তার, দীর্ঘদেহী, গায়ের রঙ গাঢ়, ঠোঁটে ফুটে আছে একটুকরো বাঁকা ছেলেমানুষী হাসি। এই হাসি নারী-পুরুষ উভয়কে আকর্ষণ করে, সেইসাথে কূটনৈতিক নানা সমস্যার সমাধানও করে সে বাঁকা হাসি হেসে।
হ্যান্ডশেক করল ওরা, বুহের কফির কাপ ধরিয়ে দিল অ্যামবাসাডরের হাতে। টিভি চলছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে আর্থার বলল, ‘স্টিভেনসনের বক্তৃতা শুনেছেন? নতুন কিছু বলেছেন?’