‘জানি,’ বলল ওয়াল্টার। ‘টিভিতে দেখেছি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন ডি কার্লো। ‘আমরা শুধু অ্যান্টিক্রাইস্টের শরীরটাই ধ্বংস করতে পেরেছি। তার আত্মা বা শক্তির কোন ক্ষতি হয়নি, তার ছেলে হয়ে উঠেছে আরেক ডেমিয়েন।’ চোখ বুজলেন তিনি, ফিসফিসে শোনাল কণ্ঠ। ‘আমি ব্যর্থ হয়েছি, আমার ভাইদের মৃত্যু বিফলে গেছে। গত মাসে এই চিঠি পাবার পর নতুন করে ব্যাপারটা উপলব্ধি করে ভীষণ হতাশ হয়ে উঠি। বুঝতে পারি আমাদের গলদ কোথায় ছিল। অজ্ঞতাই আমাদের ডুবিয়েছে।’
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ওয়াল্টার, হাঁটু কাঁপছে, মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে হঠাৎই যেন খুব বুড়িয়ে গেছে সে।
চোখ মেললেন ডি কার্লো। ‘আপনাকে যা বললাম সব লিখে রেখেছি। আমার নোট আর চিঠিগুলো নিয়ে যান। লন্ডনে গিয়ে আমেরিকান অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করুন। উনি আপনাকে সাহায্য করবেন।’
‘কেন?’ জিজ্ঞেস করল ওয়াল্টার। ‘তিনি সাহায্য করবেন কেন?’
‘তিনি সৎ মানুষ। তাঁর ক্ষমতা এবং প্রভাব আছে। উনি যা করতে পারবেন আপনার পক্ষে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাছাড়া রাষ্ট্রদূতের বয়স কম। আমরা তো বুড়িয়ে গেছি। ইচ্ছে থাকলেও আর…’ হাসলেন ডি কার্লো, হঠাৎ উঠে বসলেন, টেনে নিলেন বাইবেল।
‘আমাকে কথা দিন,’ বললেন তিনি।
ওয়াল্টার কথা বলার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু কোন শব্দ বেরুল না। ডি কার্লো ওয় হাতটা ধরে বাইবেলের ওপর রাখলেন।
‘ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে কথা দিন।’
মাথা দোলাল ওয়াল্টার। ‘কথা দিলাম।‘
‘তাহলে আসুন প্রার্থনা করি।’
দু’জনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করলেন। ল্যাটিন ভাষায় প্রার্থনা করলেন ডি কার্লো। তারপর সিধে হলেন। ওয়াল্টারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘অ্যামবাসাডরের পিছু ছাড়বেন না। উনি প্রস্তুত হলে ড্যাগারটা পাঠিয়ে দেব।’ হাসি ফুটল তাঁর মুখে। ‘পুনর্জন্ম নেয়া যীশু আপনাকে পথ দেখাবেন। তাঁকে বিশ্বাস করুন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন। পৃথিবীতে আবার আগমন ঘটেছে তাঁর। আমি জানি। আমি তাঁকে দেখেছি।’
ওয়াল্টার নোট আর চিঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর শরীর কাঁপছে। মঠ থেকে দূরে সরে আসার পর কাঁপুনিটা থেমে গেল আর সেই সাথে মনের ভেতর জেগে উঠল রাজ্যের সন্দেহ।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ৭
সাত
রোম থেকে আসা একটা ফোনের অনুরোধে কাজটা করতে রাজি হয়েছেন ফাদার টমাস ডুলান। তবে খচখচ করছে মন। এ এক ধরনের অপবিত্র কর্ম, আইন-বিরোধী। কিন্তু ওয়াল্টার তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুই শুধু নয়, চার্চের প্রতি নিবেদিত প্রাণও বটে।
ওয়াল্টার একটা নাম্বার দিয়েছে। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলেন ডুলান। ফাদারের কণ্ঠ শুনে অপর পক্ষ সানন্দে তাঁকে সাহায্য করার কথা বলল। ঘণ্টাখানেক লাগল তাঁর ঠিকানা খুঁজে, মেশিন জোগাড় করে নর্থ সাইডের কবরখানায় ফিরে আসতে। ট্যাক্সিঅলা ভাড়া নিয়ে বিদায় হলো, ডুলান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াল্টারের বন্ধুর দেয়া মেশিনটার প্রতি মনোযোগ দিলেন। বড় একটা চামচের মত যন্ত্রটা, তিন ফুট লম্বা একটা শ্যাফট, হাতলে ডায়াল সহ রঙিন টিভি পর্দাও আছে। ওয়াল্টারের বন্ধু গর্ব করে বলেছে এরচে’ কার্যকরী এবং সর্বাধুনিক টেকনোলজির জিনিস আর নেই। জুলজিস্ট এবং অ্যামেচার প্রসপেক্টরদের জন্যে অপরিহার্য যন্ত্র এটা।
ছয় ফুটে ডায়াল অ্যাডজাস্ট করে সুইচ অন করলেন ফাদার। মৃদু গুঞ্জন তুলল মেশিন। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। তারাজ্বলা নির্মেঘ আকাশ।
সুইচ অফ করে দিলেন ফাদার। গোরস্থানের গেট ঠেলে ঢুকলেন ভেতরে। যন্ত্রটাকে সামনে ধরে রেখেছেন ঘাস কাটা নিড়ানির মত। গোরস্থানটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ধনী মানুষদের এখানে কবর দেয়া হয়।
থর্ন সমাধিটি লেকের পাশে। গ্রানিট পাথরের তৈরি গোল একটা বিল্ডিং, চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। ডাবল ওকের ভেজানো দরজা, ডুলান ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।
ঘরটা গোলাকার, কতগুলো পাথরের ফলক বা ট্যাবলেট দাঁড় করানো, দেয়ালের গায়ের চোর-কুঠুরিতে একটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে।
ঘরের চারপাশ ঘুরে দেখলেন ফাদার, পাথুরে ফলকে লেখা থর্ন পরিবারের চার জেনারেশনের বংশ লতিকা পড়লেন। সবচে’ বড় ট্যাবলেটটি স্মারক-ফলক।
‘রবার্ট এবং ক্যাথেরিন থর্নের স্মৃতির উদ্দেশে,’ পড়লেন তিনি। ‘এক সাথে তাঁরা শুয়ে আছেন নিউ ইয়র্ক নগরীতে। এবং রিচার্ড ও অ্যান থর্নের স্মৃতির প্রতিও। তাঁদের আত্মা শান্তিতে ঘুমাক।’
কয়েক পা পিছিয়ে এলেন ডুলান, ঘুরলেন, তাকালেন বড় একটা মার্বেল স্ল্যাবের দিকে। ঘরের মাঝখানে ওটা। স্ল্যাবের মাথায় লেখা:
ডেমিয়েন থর্ন
১৯৫০-১৯৮২
কোন এপিটাফ লেখা নেই, শুধুই নাম। মৃত্যুর পরেও যেন জায়গাটাতে ডেমিয়েনের কর্তৃত্বের ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা মনে পড়ে গেল ডুলানের। টিভিতে দেখেছেন অনুষ্ঠানটি। এখনও চোখে ভাসে। কফিন বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সমাধির দিকে, তারপর বন্ধ হয়ে যায় দরজা। তখনও সংবাদ ভাষ্যকার বলে চলছিল ডেমিয়েনের করুণ মৃত্যুর কথা।
ডুলান মেশিনের সুইচ অন করলেন, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঢেউ নিচে নেমে গেল শিরশিরে অনুভূতি তুলে। এই জীবনে বহু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজির থেকেছেন তিনি, বহু লোককে নিজের হাতে কবর দিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁর মনে হচ্ছে কবরটা ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল, লাশটা শান্তিতে থাকুক। অথচ মনের অজান্তেই হাতল চেপে ধরে রেখেছেন তিনি, কাজ শুরু করে দিয়েছে মেশিন। কাজটা করতে বেশি সময় লাগবে না, তারপর চলে যাবেন, বললেন তিনি মনে মনে।