হাত বাড়িয়ে দিল বাচ্চা, খুদে আঙুল দিয়ে খামচে ধরল লোম, হেসে উঠল খিলখিল করে, নার্সের অন্তত তাই মনে হলো। আড়চোখে দেখল সে মৃত তরুণীকে, সঙ্গী নার্সকে ইশারা করল লাশটাকে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে। চেহারায় ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণার ভাব ফুটে উঠল তার, তবে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে হাসল।
‘আবার জন্ম নিল ঘৃণা,’ গর্বের সাথে বলল সে।
.
বাসা-বাড়ি, অফিস-ফ্যাক্টরিসহ সর্বত্র শয়তান-পুত্রের শিষ্যদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল বাচ্চার জন্মের কথা শুনে। চরম হতাশায় যাদের দিন কাটছিল, যারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছিল ব্যর্থ আক্রোশে, খবরটা তাদের সবার মাঝে নতুন আশার আলো জ্বেলে দিল। আগামীতে নতুন কিছু ঘটার প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল তারা। ওদিকে, মধ্য ইতালীর এক মঠে, ফাদার ডি কার্লো নামের একজন প্রীস্ট গভীর রাতে ধড়মড় করে উঠে বসলেন নিজের বিছানায়। ঘামে ভিজে গেছে গা, ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি, ভয়ঙ্কর এক সত্য উপলব্ধি করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পেরেছেন ব্যর্থ হয়েছেন তিনি, আবার শুরু হতে যাচ্ছে অশুভ সঙ্কেতের দিন। যা হবে অতীতের চেয়েও ভয়াল ভয়ঙ্কর।
আবার অশুভ সঙ্কেত – ১
এক
প্রায় এক ঘণ্টা হলো হিথ্রো এয়ারপোর্টের প্রাইভেট লাউঞ্জে বসে আছে যুবক। রানওয়ে আর বার ছুঁয়ে যাচ্ছে তার অস্থির দৃষ্টি, উত্তেজনা কমাতে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। একটু পরপর ঘড়ি দেখছে সে, হাতে ধরা কাগজের তাড়ায় চোখ বোলাচ্ছে। বুড়োর সাথে এর আগে সাক্ষাৎ হয়নি তার, তবে জানে পল বুহেরের চোখ ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত কঠিন। উল্টোপাল্টা কিছু বললে বা ভুল কোন তথ্য দিলে সে খুবই বিরক্ত হয়।
হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল লাউডস্পীকার। একঘেয়ে একটা কণ্ঠ বলতে শুরু করল:
‘থর্ন কর্পোরেশনের প্রাইভেট চার্টার শিকাগো থেকে এইমাত্র ল্যান্ড করল।’
যুবক সশব্দে দম ফেলল।
‘প্লেনের যাত্রী মি. পল বুহের এক্ষুণি টার্মিনাল লাউঞ্জে এসে পৌঁছুবেন। ধন্যবাদ।’
দ্রুত টাইয়ের নট ঠিক করল যুবক, জামার বোতাম লাগাল। থর্ন কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং বেশিরভাগ শেয়ারের অংশীদার পল বুহের পশ্চিমা বিশ্বের সবচে’ ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন। এই মানুষটির একক প্রচেষ্টায় থর্ন কর্পোরেশন বিশ্বের বৃহত্তম মাল্টিন্যাশনাল কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। বুহের ত্রিশ বছর আগেই বুঝতে পেরেছিল পৃথিবীতে খাদ্য হলো সবচে’ প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক পণ্য। সে তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করে ফেলেছে বহু আগে, বর্তমানে থর্ন কোম্পানিকে বিশ্বের বৃহত্তম ফার্টিলাইজার এবং সয়া ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে সবাই চেনে। পল বুহের প্রায়ই বলে ‘আমাদের লাভজনক ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে দুর্ভিক্ষের মধ্যে।’
বর্তমানে বুহের পরিণত হয়েছে জীবন্ত এক কিংবদন্তীতে।
যুবক তাকিয়ে আছে বাইরে, থর্ন-এর ব্যক্তিগত প্লেন খুঁজছে, এমন সময় লাউঞ্জের দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল পল বুহের। লম্বা, একহারা গড়ন, মাথায় কোঁকড়ানো, সাদা, ঘন চুল।
‘মি. বুহের, দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গেল যুবক। ‘আমার নাম জন। লন্ডনে স্বাগতম,’ অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডদের মত শোনাল কথাগুলো।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, জন,’ হাসল বুহের। ‘নাইস অভ ইউ টু মিট মি।’
বুহেরের প্রবল ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতির কাছে নিজেকে নিতান্তই খেলো মনে হলো জনের। বিনীত গলায় বলল, ‘আপনার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে, স্যার।’
‘ঠিক আছে,’ মাথা ঝাঁকাল বুহের। মনে মনে বলল, ব্যাটা বেশি ফাজিল।
.
পুব দিকে ছুটে চলেছে লিমোজিন, জন একটানে খুলে ফেলল ককটেল ক্যাবিনেট। মাথা নেড়ে নিষেধ করল পল বুহের। খাবে না।
‘লিবিয়ানদের কাছ থেকে কোন সাড়া পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘না, স্যার,’ বলল জন।
‘অসুবিধে নেই। ওদের ফ্যাসিলিটি আরও তিন হপ্তা বাড়িয়ে দাও আর সুদের হারও দেড় গুণ বাড়াও।’
চোখ পিটপিট করল জন। ‘ওরা আপত্তি তুলতে পারে, স্যার।’
‘ওদের তো সবকিছুতেই আপত্তি। যাকগে, আমি একটু চোখ বুজলাম। অফিসে পৌছুলে জাগিয়ে দিও।’
সীটে হেলান দিল বুহের। জন শঙ্কিত হয়ে ভাবল ওর কোন কথায় বস্ আবার মাইন্ড করে বসেননি তো।
টেমস নদীর দক্ষিণ তীরে, ইংরেজী ‘টি’ অক্ষরের আদলে গড়ে উঠেছে থর্ন কর্পোরেশনের ব্রিটিশ হেড অফিস। থর্ন লোগোটি শিকাগোর হেডকোয়ার্টারের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে। টপ ফ্লোরে, নিজের স্যুইট থেকে চেয়ারম্যান টেমস নদী এবং ব্যাংক অভ ইংল্যান্ড পরিষ্কার দেখতে পায়। বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়ে হাউজ অভ পার্লামেন্ট। ফোন করার সময় বুহের দালানটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
অফিসে পৌঁছেই বুহের খোঁজ নিল গত দু’দিনে তার নামে কতগুলো টেলেক্স এসেছে। তারপর বলল আগামী একঘণ্টার মধ্যে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। এক ঘণ্টার মধ্যে তাকে কেউ বিরক্ত করল না। নির্ধারিত সময় শেষে তার সেক্রেটারি বসের স্যুইটে নক করল, দরজা খুলে তাকাল ভেতরে।
‘হ্যাপী বার্থডে, স্যার,’ বলল সে।
বুহের মুখ তুলে চাইল, হাসি ফুটল মুখে, সেক্রেটারির পেছনে দেখা যাচ্ছে লন্ডন হেডকোয়ার্টারের বড়-মাঝারি গোছের সকল কর্মকর্তাদের।