আবার অশুভ সঙ্কেত – ৬
ছয়
শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের ড্যাগার বিষয়ক লেখাটি ছাপা হলো পত্রিকায়। এর দিন কয়েক পরে, শিকাগোর এক বাড়িতে, লেখাটা পড়ার সময় কফির কাপ হাত থেকে পড়ে গেল এক বুড়োর।
দ্রুত পড়া শেষ করল সে, তারপর তার প্রীস্টকে ফোন করল। নিজের স্টাডিরুমে ঢুকল বুড়ো, বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ পর উত্তেজিত বৃদ্ধ লন্ডনে, ফ্লিট স্ট্রীটের নাম্বারে ফোন করল।
‘আমার নাম নিকোলাস ওয়াল্টার,’ বলল সে। শিকাগো থেকে বলছি। আপনাদের এক সাংবাদিক, শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’
‘দুঃখিত,’ ভেসে এল একটি পুরুষ কণ্ঠ। ‘মিস ফেয়ারচাইল্ড এক হপ্তা ধরে নিখোঁজ। তাকে খুঁজছেন কেন জানতে পারি?’
নিকোলাস ওয়াল্টার কথা বলছে, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। উঁকি দিলেন ছোটখাট, রোগা একজন মানুষ। পরনে ধূসর কোট। ওয়াল্টার লোকটিকে ইশারা করলেন ভেতরে আসতে। ফোনের আলাপ সেরে ঘুরল সে, হাত মেলাল প্রীস্টের সাথে। পত্রিকাটি দিয়ে ইঙ্গিত করল শ্যারনের লেখাটি পড়তে।
প্রীস্ট ধীরে ধীরে পড়লেন। ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত, না?’ মন্তব্য করলেন তিনি পড়া শেষে।
‘খুব,’ বলল ওয়াল্টার।
এরপর দু’জনে মিলে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ চলল। ওয়াল্টার বলল কিভাবে এক নিলামে সে ড্যাগারগুলো পেয়েছিল আর প্রীস্ট সেগুলো নিয়ে ইটালিতে, সুবিয়াকোর এক মনাস্টেরিতে গিয়েছিলেন।
‘ব্যাপারটা যদি আগে জানতাম,’ বললেন প্রীস্ট। ‘তাহলে যেখানের জিনিস সেখানে ফেলে রাখলেই ভাল হত।’
‘ভেবে দেখুন,’ বলল ওয়াল্টার। ‘ইটালিয়ান লোকটা কিন্তু একবারও বলেনি সে ওগুলো দিয়ে কি করতে যাচ্ছে।’
‘কেউ বলেনি।’ এদিক-ওদিক
মাথা নাড়ছে নিকোলাস ওয়াল্টার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে। পত্রিকায় কয়েকজন লোকের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ওদের মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে ওয়াল্টারের।
‘ডি কার্লো বেঁচে আছে কিনা জানেন?’
কাঁধ ঝাঁকালেন প্রীস্ট। ‘জানি না। তবে মনাস্টেরিতে ফোন করে দেখতে পারেন।’
‘যদি বেঁচে থাকে, যাবেন আমার সাথে ওকে দেখতে?’
‘কেন? তাতে লাভ কি?
‘আমার কৌতূহলের নিরসন হবে।’
মাথা নাড়লেন প্রীস্ট। ‘আমার অত কৌতূহল নেই। তাছাড়া, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।’
‘তবে আমি যাব,’ বলল ওয়াল্টার। ‘আমার হাতে অঢেল সময়। আর রোমের মত জায়গায় ছুটি কাটানোর জন্যে এটা হলো সবচে’ উপযুক্ত সময়।’
নিকোলাস ওয়াল্টার তার ষাট বছরের জীবনে নিজের শহর ছেড়ে খুব কমই বাইরে গেছে। সারাটা জীবন সে কাটিয়ে দিয়েছে বইপত্রের মাঝে, প্রাচীন ইতিহাস আর বাইবেল পড়ে। বাইবেলের বিষয়ে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যায়। সে পণ্ডিত মানুষ, সন্দেহ নেই। তবে আধুনিক জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা সামান্যই।
প্লেন ভ্রমণটা উপভোগ করল নিকোলাস ওয়াল্টার। নিজেকে বেশ সজীব আর তরুণ লাগছে। মদ পান না করার বহুদিনের অভ্যাস সে ভেঙে ফেলল স্টুয়ার্ডেসের কাছ থেকে ককটেলের গ্লাস নিয়ে।
রোমে পৌঁছে সময় নষ্ট করল না ওয়াল্টার। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা পুবে, সুবিয়াকোর উদ্দেশে ছুটল। শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার অনেক সময় পাবে সে। আগে ফাদার ডি কার্লোর সাথে দেখা করা দরকার। ম্যাপে রাস্তা দেখে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডি কার্লোর মঠে পৌঁছে গেল ওয়াল্টার।
ওটাকে মঠ না বলে মঠের ধ্বংসাবশেষ বললেই মানায়। পাহাড়ের ওপর, কালো পাথরে তৈরি জরাজীর্ণ একটা দালান। সন্ধ্যা নেমেছে। অথচ দালানের কোথাও আলো জ্বলছে না। জানালা-টানালাও চোখে পড়ল না। গা-টা হঠাৎ শিরশির করে উঠল ওয়াল্টারের।
গাড়ি থামাল সে, বন্ধ করল ইঞ্জিন। চারপাশ আশ্চর্য নীরব। খোয়া ওঠা রাস্তা ধরে ভারী ওক কাঠের দরজাটার দিকে এগোল ওয়াল্টার, নীরব প্রার্থনার ভঙ্গিতে ঠোঁট নড়ছে। যে লোক তার জীবন কাটিয়েছে লাইব্রেরীর চৌহদ্দিতে, সে আজ শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসকে দেখছে চোখের সামনে। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন মনে হতে লাগল ওয়াল্টারের।
পাথরের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল সে, কানে ভেসে এল নীচু গলার প্রার্থনা সঙ্গীত। লোহার ভারী কড়া ধরে নাড়া দিল। শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলল দালানে, তবে প্রার্থনাকারীদের মনোযোগ নষ্ট হলো না তাতে। এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর খুলে গেল দরজা। এক সন্ন্যাসী, আলখেল্লায় মুখটা প্রায় ঢাকা, নীরবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নিজের পরিচয় দিল ওয়াল্টার, সন্ন্যাসী সরে দাঁড়াল ওকে ভেতরে আসতে দেয়ার জন্যে।
‘আপনি এসেছেন, আমরা খুশি হয়েছি,’ পরিষ্কার ইংরেজীতে বলল সন্ন্যাসী। ‘আশা করি আপনাদের বিরক্ত করছি না।’
‘ফাদার ডি কার্লো আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আজকাল কেউ আসে না তাঁকে দেখতে।’
‘কেমন আছেন উনি?’
‘তাঁর অন্তর বড়ই বিক্ষিপ্ত।’
ওয়াল্টার সন্ন্যাসীর পিছু পিছু একটা প্যাসেজ ধরে এগোল, তারপর ঢুকল একটা সরু করিডরে। জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, বাতাসে নোনা গন্ধ। আবার শিউরে উঠল ওয়াল্টার।
একটা দরজার সামনে দাঁড়াল সন্ন্যাসী, টোকা দিল, তারপর ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল। ছোট একটা ঘরে ঢুকল ওয়াল্টার, দেখল সরু একটি চৌকিতে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। ফাদার ডুলান বলেছিলেন ডি কার্লো লম্বা-চওড়া মানুষ, প্রকাণ্ড মুখ, চওড়া চোয়াল, ঈগলের মত নাক। বয়সের কারণে ডি কার্লোর চেহারায় পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এ কি দশা হয়েছে মানুষটার? খুলির চারপাশে কুঁচকে আছে চামড়া, নড়া-চড়া অত্যন্ত ধীর। বিছানা থেকে উঠে বসার সময় যন্ত্রণার ছাপ ফুটল চেহারায়।