হঠাৎ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পড়ার তীব্র ইচ্ছে জাগল মনে। কেন জানি ভয় লাগছে ওর।
দরজা খুলে ড্রাইভওয়েতে পা রেখেছে শ্যারন, কিসের সাথে যেন হোঁচট খেল। বড়, নুড়ি পাথর একটা। জুতো খুলে ফেলল ও। পায়ে নুড়ির খোঁচা লাগছে। গ্রাহ্য করল না শ্যারন। বাতাসের বেগ বাড়ছে। লনের কাছে এসেছে, হঠাৎ মনে হলো কেউ আড়াল থেকে ওকে দেখছে। পেছন ফিরে তাকাল শ্যারন। ভেবেছিল কুকুরটাকে দেখবে। নেই ওটা। কেউ নেই। লন পার হয়ে ঝোপের দিকে এগোল ও, অজান্তে বেড়ে গেছে চলার গতি। কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না তবে বোটকা গন্ধটা যেন গলার ভেতর ঢুকে আছে। বমি আসছে। বাড়িটা থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে শ্যারন, গন্ধটা তত প্রবল হয়ে উঠছে
ঝোপগুলোর মাঝখানে একটা রাস্তা। ওই পথ ধরে হোঁচট খেতে খেতে ছুটল শ্যারন। দুইবার প্রায় আছাড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল গাছের শেকড়ের সাথে পা বেঁধে। ডালগুলো বাড়ি মারছে মুখে। এক হাতে মুখ ঢেকে দৌড়াচ্ছে শ্যারন। বারবার দেখা দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়ছে। স্বপ্নের মধ্যে কে যেন ওকে তাড়া করে। কাঁপতে কাঁপতে বহুবার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে শ্যারন। স্বপ্নটা এমনভাবে গেঁথে আছে মনে, সিনেমায় কাউকে তাড়া করার দৃশ্য দেখলেও আঁতকে ওঠে ও।
দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যারন। ঝোপগুলো এদিকে অনেকটা হালকা। এরপরে ঘাসের জমিন, তারপর দেয়াল, সবশেষে দেয়ালের ওপাশে শ্যারনের গাড়ি। আবার দৌড় শুরু করল শ্যারন। একটু পর থেমে গেল। আবারও ঝোপের রাজ্য! ব্যাপারটা কি? হতভম্ব হয়ে গেল শ্যারন। ও কি তাহলে একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরে মরছে? নিজেকে বকা দিল শ্যারন। দিক ঠিক করে কখনও চলতে পারে না ও।
আবার শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে এল, হাত দুটো বুকে চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে শ্যারন। ঝোপ ঠেলে অন্ধের মত খুঁজছে খালি মাঠটা। মাঠের পরেই দেয়াল। মাঠে পৌঁছুতে পারলেই হলো। কিন্তু এ পথ যে শেষ হয় না। কত বড় এস্টেট এটা? চারশো একর না? এখন হোক আর খানিক পরে হোক, দেয়াল চোখে পড়বেই শ্যারনের। তারপর সে পেরিফোর্ড ছেড়ে চলে যেতে পারবে।
.
নিঃশব্দে মেয়েটার পিছু নিয়েছে কুকুরটা। পঞ্চাশ গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করে চলেছে ওকে। মেয়েটা থামলে সেও দাঁড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা যখন মাঠে চলে এল দু’জনের মাঝে দূরত্ব রইল ত্রিশ গজ। দাঁড়িয়ে পড়ল কুকুর, নাক উঁচু করে শ্বাস টানল, দেখল মেয়েটা ঘাস জমিনের ওপর দিয়ে দৌড় শুরু করেছে। সেও দৌড়াল। এবার আগের চেয়ে জোরে। চওড়া বুকটা উঠছে-নামছে, লাফ মেরে প্রতি সেকেন্ডে দূরত্ব কমিয়ে আনছে সে…
কোন শব্দ শুনতে পেল না শ্যারন, টের পেল বোটকা গন্ধটা বেড়েই চলেছে। ওটার উপস্থিতি অনুভব করল যখন জানোয়ারটা প্রায় ওর গায়ের ওপর উঠে পড়েছে, সেই সময়। ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল শ্যারন, কোমরে লোহার মত শক্ত মাথার প্রচণ্ড গোত্তা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। চিৎকার দেয়ার সময়ও পেল না, উঠতে যাচ্ছে, কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কামড় বসাল পায়ের গোছে। ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাচ্ছে ওটা, চোয়ালজোড়া বন্ধ হলো সশব্দে, হাড় আর মজ্জা ভেদ করে ঢুকে গেল তীক্ষ্ণ দাঁত; এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল শ্যারন। মুখ তুলল কুকুর, কটমট করে চাইল শ্যারনের দিকে, তারপর ছেড়ে দিল ওকে। মিশে গেল অন্ধকারে।
.
তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে গেছে শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। ফোঁপাচ্ছে। আহত পা-টায় আগুন ধরে গেছে, একটুও নড়াতে পারছে না। কুকুরটা ওর পায়ের শিরা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। জানে হাঁটতে পারবে না। তাই হামাগুড়ি দিয়ে এগোল।
ব্যথা সহ্য করতে পারছে না শ্যারন। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলল। দেয়াল পর্যন্ত যেতে পারলে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করবে শ্যারন। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই শুনবে ওর আকুতি।
দশ গজ এগোতে এক ঘণ্টা লাগল শ্যারনের। নিচতলার জানালার ধারে বসে ছেলেটা আর তার কুকুর দেখছে ওকে। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে বৃথাই ঘণ্টাখানেক কান্নাকাটি করল শ্যারন। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল ঘাসের ওপর। ফোঁপাচ্ছে।
একটু পর ফোঁপানি থেমে গেল শ্যারনের। ছেলেটা চার হাত-পায়ে কুকুরের মত এগিয়ে গেল ওর দিকে। নড়ে উঠল শ্যারন, মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল কে আসছে। কিন্তু বেশিক্ষণ মাথা তুলে রাখতে পারল না, ধপ্ করে পড়ে গেল। কাউকে দেখতে পায়নি সে। ওকে নড়তে দেখে ছেলেটা ঝোপের আড়ালে চলে গেছে। ওখানেই উবু হয়ে বসে থাকল সে সকাল পর্যন্ত। ভোরের দিকে নড়াচড়া সম্পূর্ণ থেমে গেল শ্যারনের, এবার ছেলেটা এগোল তার দিকে।
.
দুঃস্বপ্ন দেখছে শ্যারন। তার স্বপ্নে ভিড় করে এল শেয়াল, হায়েনা, শকুন আর হরর ছবির বিকট জিন্দালাশের দল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ওর। উপুড় হয়ে পড়ে আছে শ্যারন। লালা শুকিয়ে আছে মাটিতে। যন্ত্রণায় মাটি খামছে ধরায় উঠে গেছে হাতের চামড়া। জ্বালা করছে। তবে পায়ে কোন সাড়া পাচ্ছে না। মাথা তুলতেই পা-টা নাড়া খেল, আগুন ধরে গেল শরীরে। এবার ছেলেটাকে দেখতে পেল শ্যারন। ন্যাংটো। চার হাত-পায়ে ভর করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। হাসার চেষ্টা করল শ্যারন, কথা বলতে চাইল, আওয়াজ বেরুল না গলা থেকে। এটাকেও দুঃস্বপ্নের একটা অংশ মনে হলো। ছেলেটা তাকিয়ে আছে ওর চোখে চোখ রেখে। হলুদ চোখ। ওর নিশ্বাসে দুর্গন্ধ, কুকুরটার মত। শ্যারনের ওপর শুয়ে পড়ল ছেলেটা। গুঙিয়ে উঠল শ্যারন। বুঝতে পারছে না ছেলেটার মতলব। হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে তীক্ষ্ণ ছুঁচ ফুটল, কামড় দিয়েছে ছেলেটা। মুখ হাঁ করল শ্যারন, চিৎকার দেবে, শেষ মুহূর্তে পরিতৃপ্তিসূচক ঘোঁৎ ঘোঁৎ একটা শব্দ শুনতে পেল। তারপর একটানে শ্যারনের সার্ভিকাল নার্ভ ছিঁড়ে ফেলল ছেলেটা দাঁত দিয়ে। ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল শ্যারনের চোখে।