এত সুদর্শন তরুণ জীবনে দেখেনি শ্যারন।
‘হ্যালো,’ কথা বলার সময় ভাঙা বাঁশির সুরের মত শোনাল গলা।
জবাবে নড় করল তরুণ; নীরবে দেখছে শ্যারনকে। ভুবন ভোলানো হাসিটি উপহার দিল শ্যারন ওকে, পা বাড়াল। ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর পথ আটকে দাঁড়াল।
‘আপনি কে?’ জিজ্ঞেস করল সে।
উচ্চারণটা কোন্ এলাকার ধরতে পারল না শ্যারন, তবে গলার স্বর ভারী আর গভীর।
‘আমি শ্যারন। তুমি কে?’
‘এখানে কি চাই?’ থমথমে গলায় প্রশ্ন করল তরুণ।
‘কিছু না। এমনি পার্কটা ঘুরে দেখছিলাম।’ আবার হাসল শ্যারন। তবে অপরজন হাসল না। শ্যারনের বিখ্যাত হাসি দেখে এই প্রথম কোন পুরুষ মানুষের চেহারায় ভাব ফুটল না। স্রেফ পাথর চোখে ছেলেটা তাকিয়ে রইল তার দিকে
‘এটা পার্ক নয়।’
‘ওহ্, আমি ভেবেছিলাম-’
‘এটা প্রাইভেট এস্টেট।’
‘তাই?’
অনধিকার প্রবেশের অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত শ্যারন। তুমি যতই রূপবান আর শক্তিশালী হও না কেন আমাকে এড়িয়ে যাওয়া তোমার কম্মো নয়, ভাবছে ও।
‘আপনি বাড়িটা দেখতে চান?’
‘ধন্যবাদ। হ্যাঁ…’ হুট করে আমন্ত্রণটা আসবে চিন্তাই করেনি শ্যারন, কি বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা ঘুরে দাঁড়াল, তারপর হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু পিছু এগোল ও। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল, বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ কুকুরটাকে দেখে। বুক হিম করা ডাক ছাড়ল ওটা, গায়ের লোম খাড়া। ছেলেটা মাত্র একবার তাকাল জানোয়ারটার দিকে, সাথে সাথে থেমে গেল গর্জন।
শিউরে উঠল শ্যারন। ‘আমি এতবড় কুকুর জীবনেও—’
‘ওটা রটউইলার, ব্যাখ্যা দিল ছেলেটা। ‘একসময় মাল টানার কাজে ব্যবহার করা হত ওদের। শিকারেও পটু। কাউকে একবার বাগে পেলে…’ হাসল সে।
‘শিকার আমি ঘেন্না করি,’ বলল শ্যারন।
‘হ্যাঁ,’ সায় দিল তরুণ। আপনার করারই কথা।’
ভেতরে ঢুকল ছেলেটা শ্যারনকে নিয়ে, পেছনে নিঃশব্দে ছায়ার মত অনুসরণ করে চলল কুকুর। বোটকা গন্ধ আসছে ওটার গা থেকে। নাক কোঁচকাল শ্যারন।
হলঘরের মাঝখানে চলে এসেছে শ্যারন, চারপাশে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কি প্রকাণ্ড গ্যালারি, ঝুড়ি থেকে লতা ঝুলছে। ওখান থেকে ক্যাথেরিন থর্ন পড়ে গিয়েছিল, ভাবল শ্যারন।
‘আপনি ঘুরে-ফিরে দেখুন,’ বলল ছেলেটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। কুকুরটা থাকল শ্যারনের সাথে।
‘অনেক ধন্যবাদ,’ বলল শ্যারন। দেখল কুকুরটা আগের মত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এখানেই তাহলে সব ঘটনা ঘটেছে, ভাবছে শ্যারন। এটাকে এখন আর ভূতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে না। হলঘর পার হয়ে ড্রইংরুমে চলে এল, ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সিঁড়ির দিকে তাকাল। ছেলেটা কোথায় গেল? ছেলেটার সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করবে সে এখানে থাকে কিনা আর এ বাড়ির ইতিহাস সে কতটা জানে। একবার যখন ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছে, সব খুঁটিয়ে দেখবে শ্যারন।
হঠাৎ শ্যারন খেয়াল করল ও একা। চলে গেছে কুকুরটা।
চ্যাপেলে, তার বাবার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, দৃষ্টি লাশের চোখের দিকে। ঠোঁট নড়ছে তার। নীরবে প্রার্থনা করে চলেছে। হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরল সে।
‘ক্ষমা করো, পিতা, আমার অযোগ্যতাকে ক্ষমা করে দাও,’ মৃদু গলায় বলল তরুণ।
এক পা পিছিয়ে এল সে, ঘুরল, জ্বলন্ত চোখে তাকাল যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে।
‘তুমি,’ ঘৃণাভরে বলল সে, ‘ভেবেছ তোমার নোংরা কৌশল দিয়ে আমার মন ভোলাবে। এজন্যে ওই সুন্দরী ছলনাময়ীকে আমার কাছে পাঠিয়েছ, তাই না? ঠিক যেভাবে আমার মাকে পাঠিয়েছিলে আমার বাবার কাছে। বাবার মত আমাকেও মিথ্যে আবেগের ফাঁদে ফেলতে চেয়েছ। আমার শক্তিকে দুর্বল করতে চেয়েছ কামনার ফাঁদ পেতে।’
ক্রুশের পেছন দিকে চলে এল সে, ড্যাগারের হাতল চেপে ধরল, চাড় দিয়ে কাঠের ভেতর ঢুকিয়ে দিল ফলা।
‘তার ফল হলো এই,’ হিসিয়ে উঠল সে, একটানে বের করে আনল ড্যাগার। এক মুহূর্ত কটমট করে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে, তারপর চলে এল লাশের কাছে, বৃত্ত করে ঘুরল চারপাশে, শিরদাঁড়ায় হাত বোলাল। পঞ্চম ভার্টেব্রার নিচে গভীর একটা ক্ষত। আঙুল কেঁপে উঠল ওখানে ছোঁয়া লাগতে। আবার ড্যাগারের দিকে তাকাল সে।
‘ছলনাময়ীরা সবাই খুনী,’ ফিসফিস করল সে। ‘আমার বাবাকেও খুন করেছে এক ছলনাময়ী।’ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে এক মুহূর্ত, তারপর এক লাফে চলে এল যীশুর মূর্তির সামনে, দড়াম করে ঘুষি মারল মুখে, আবার ড্যাগার ঢুকিয়ে দিল মেরুদণ্ডে।
‘ভেবেছ তুমি প্রলোভন সম্পর্কে সব জানো,’ আবার মূর্তির সামনে চলে এল ছেলেটা। ‘ভেবেছ তুমি প্রলোভন জয় করতে পেরেছ। কিন্তু তোমার চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত তোমাকে কিছুই শেখায়নি। তুমি এই মেয়েটাকে পাঠিয়েছ আমার নিয়তি, আমার কর্ম থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে, তোমার রাস্তায় আমাকে নিয়ে যেতে। এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল সে। কিন্তু তুমি ব্যর্থ হয়েছ, এবং সবসময় তাই হবে।’
হাত বাড়িয়ে মুখ ছুঁলো সে তারপর ঘুরে দাঁড়াল।
.
অনেক ঘোরাঘুরি করেছে শ্যারন। সাঁঝ নামছে। বাড়ি ফেরা দরকার। নাক কুঁচকে রেখেছে ও। এ বাড়ির সব জায়গায় কুকুরটার গায়ের বমি আসা গন্ধ। তবে ছেলেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শীত শীত লাগছে শ্যারনের। পাতলা ব্লাউজ আর সামার স্কার্ট ঠাণ্ডা বাতাস ঠেকাতে পারছে না।