কাগজে চোখ বোলালেন জামশেদুর রহমান। হতে পারে। এরকম হাতলঅলা ড্যাগারের কথাই বোধহয় শুনেছিলাম। কিন্তু রাষ্ট্রদূতকে এ ব্যাপারটা নিয়ে যেন বিরক্ত করতে যেয়ো না। আমি চাই না-’
শ্যারন ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঘাড় ফিরিয়ে ‘থ্যাঙ্কস’ বলল, তারপর পা বাড়াল দরজার দিকে।
.
পাঁচ ড্যাগারের ওপর দ্রুত ফিচার লিখে ফেলল শ্যারন। তারপর ফোন করল আমেরিকান এমব্যাসিতে। প্রেস অ্যাটাশে জানাল অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করতে চাইলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে হবে শ্যারনকে। লিখিত অনুরোধ সহ প্রশ্ন পাঠাতে হবে।
‘পাঠাব,’ খুশি খুশি গলায় বলল শ্যারন। কোম্পানি নোট পেপারে প্রশ্ন লিখেও ফেলল ঝটপট। এক লোককে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিল গ্রসভেনর স্কোয়ারে, আমেরিকান দূতাবাসে। তারপর হেসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল শ্যারন। প্রটোকল ভাঙছে সে, তো কি হয়েছে? বস্ যদি অনুযোগ করেন তাঁকে না জানিয়ে কেন কাজটা করতে গেল শ্যারন কিংবা জামশেদুর রহমান রেগে যান, জবাবে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসবে শ্যারন। বলবে অনভিজ্ঞতা এবং যৌবনের উচ্ছ্বাস থেকে কাজটা করে ফেলেছে সে। তাঁরা যেন ব্যাপারটাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। আর যদি রোমের ড্যাগারের সাথে অমীমাংসিত মৃত্যুগুলোর মাঝে কোন সূত্র যোগ করতে পারে শ্যারন, তাহলে কেল্লা ফতে। দারুণ একটা গল্প হবে ওটা। ঝুঁকি নেয়াটা সার্থক হয়ে উঠবে।
.
পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল শ্যারন। আজ ওর অফ ডে। আজ পেরিফোর্ডে যাবে ঠিক করেছে। থর্ন পরিবারের প্রাসাদ-বাড়ির ছবিতে আবার চোখ বোলাল শ্যারন। লেখক বলছেন চারশো একর জমি নিয়ে এ বাড়ি, তেষট্টিটা ঘর, দুটো উইং। ১৯৩০ সালে বাড়ির একাংশে আরেকটা বিল্ডিং তৈরি করা হয়। ওখানে মাছ ধরার পুকুর আছে, আছে টেনিস কোর্ট, সব্জি বাগান…’
ঘণ্টাখানেক লাগল জায়গাটা খুঁজে বের করতে। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখে ড্রাকুলা আর তার ট্রানসিলভেনিয়ার ভৌতিক দুর্গের কথা মনে পড়ে গেল শ্যারনের। ঝলমলে সূর্যালোকিত দিন। ভরত পাখিরা মনের আনন্দে গাইছে। গাড়ি চালাতে চালাতে মুচকি হাসল শ্যারন ড্রাকুলার কথা ভেবে। এমন নির্জন জায়গায়, বিরাট প্রাসাদে, সত্যি ড্রাকুলা নেই তো?
রাস্তার ধারে গাড়ি থামাল শ্যারন। নেমে পড়ল। একটা মাঠ পেরোল। মাঠের পর প্রকাণ্ড বাড়িটা। চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কমপক্ষে দশ ফুট উঁচু। কয়েক জায়গায় ইট খসে পড়ে মুখ হাঁ করে আছে গর্ত। শ্যারন ভাবল, বাইরে একটা চক্কর দিয়ে ফিরে যাবে কিনা। তারপর রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করবে। কিন্তু দেয়ালের ওপাশে কি আছে দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। দেখলে ক্ষতি কি? ধরা পড়লে মিষ্টি হেসে বলবে সে ভেবেছিল এটা একটা পার্ক।
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এক ফুট একটা ফাটলের মধ্যে শরীর গলিয়ে দিল শ্যারন।
.
অ্যালার্ম সিস্টেম বেজে উঠতে অবাক হলো ছেলেটা। ক্লোজ-সার্কিট টিভির বোতামে চাপ দিল। পর্দায় ফুটে উঠল শ্যারনের ছবি। দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে দেয়ালের ফাঁকে, কি যেন ভাবছে। তারপর পিছলে নেমে এল জমিনে, ঘাসের ওপর। ছেলেটার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেল, কুকুরটাও নড়েচড়ে উঠল। জানালার বাইরে কটমট করে তাকাল, দাঁড়িয়ে গেছে লোম, গলার ভেতর থেকে গরগর আওয়াজ বেরিয়ে এল, নাক কোঁচকাল, বেরিয়ে পড়েছে ঝকঝকে সাদা দাঁত।
হাত বাড়িয়ে জানোয়ারটার কাঁধ ছুঁলো সে। কুকুরটা তাকাল তার দিকে, হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করছে। ছেলেটা কুকুরটার লোমের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিল, ধরে রাখল ওকে। কুঁচকে যাবার ভঙ্গিতে ভাঁজ পড়ল কুকুরটার কপালে, ঘুরল, তাকাল টিভি পর্দার দিকে। হাঁপাচ্ছে। জিভ বেয়ে লালা পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কার্পেট।
ক্লোজ-আপে টিভি অ্যাডজাস্ট করল ছেলেটা, আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে শ্যারনের দিকে। শ্যারন লন ধরে হাঁটছে।
মেয়েটাকে দেখে অস্থির হয়ে উঠল কুকুর, কিন্তু ছেলেটা ছাড়ল না ওকে। শ্যারন একটা ঝোপের ধারে চলে এসেছে। হঠাৎ বাড়ি খেল লম্বা একটা ডালে। দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যারন। ছেলেটা ওর চোখে পানি দেখতে পেল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো তার। ইচ্ছে করল মেয়েটার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে দু’একটা সান্ত্বনাবাক্য শুনিয়ে আসে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে শ্যারনের দিকে। চিবুক ডলতে ডলতে আবার রওনা হয়েছে মেয়েটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে আসবে। লাফ মেরে সিধে হলো ছেলেটা, এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, করিডর পেরিয়ে, দ্রুত নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। কুকুরটা তার পায়ের সাথে সেঁটে রইল। সাইড ডোর খুলে পা বাড়াল সে লনের দিকে। কুকুরটা দাঁড়িয়ে থাকল দোরগোড়ায়।
.
ঝোপের পরে সুন্দর ভাবে ছাঁটা ঘাসের লন। লনের শেষ মাথায় প্রকাণ্ড বাড়িটা। বাড়িটা খুব সুন্দর তবে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। চাঁদনি রাতে রোমান্টিক পার্টির জন্যে দারুণ জায়গা, ভাবল শ্যারন। বাড়িতে কেউ থাকে না? মুখ তুলে চাইতেই ছেলেটাকে দেখতে পেল সে। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে এল শ্যারনের, স্কুল ছাত্রীদের মত মুখে হাত চাপা দিল। যেন ছেলেটাকে দেখে খুব লজ্জা পেয়েছে।