.
মীটিংটা হলো পিএলও আর নেসেটের মধ্যে। বরাবর যা হয়ে আসছে, এবারও তাই হলো। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। পিএলও-র তরুণ সদস্যদের কাছে ‘সমঝোতা’ শব্দটাই নাকি অশ্লীল মনে হয়। আর বোমা বর্ষণের পর থেকে নেসেটের আচরণও বদলে গেছে অনেক। বহিরাগত কোন পক্ষের পরামর্শ বা চাপকে তারা থোড়াই কেয়ার করছে।
ডিবেট রুমে দু’পক্ষের বক্তব্য শুনল আর্থার ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে। যে যাই বলছে, তাতে শেষতক কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ একটা পরামর্শ দিলে ওটা নিয়ে আলোচনা শুরু হবার আগেই আরেকজন এমনভাবে আপত্তি তুলছে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার কোন অবকাশই থাকছে না।
মীটিং শেষ হলো ওভাবেই-অগোছাল এবং কোন সমাধান ছাড়াই। চিন্তিত মুখে মীটিং থেকে বেরুল আর্থার, তাই শুনতে পেল না একজন তার নাম ধরে ডাকছে। হঠাৎ আস্তিনে টান পড়তে ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল সে। বেঁটেখাটো, মোটাসোটা এক লোক, হাতে মখমলের পাউচ।
‘সিনর আর্থার, আমার নাম পাভোত্তি, হোটেল সিকিউরিটি।’
মাথা ঝাঁকাল আর্থার।
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, স্যার। এক লোক বসে আছে আমাদের অফিসে। আপনার সাথে দেখা না করে নাকি যাবেই না।’
‘ওকে আমার—’
‘লোকটা বলছে সে নাকি সন্ন্যাসী,’ বলল পাভোত্তি। পাউচটা আর্থারের হাতে তুলে দিল সে। ‘এ জিনিসটি আপনাকে দিতে বলেছে সন্ন্যাসী।’
বটুয়াটার মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধা। খুলতেই বেরিয়ে এল ক্ষুরধার এক ড্যাগার। দম বন্ধ করে ভয়ঙ্কর অস্ত্রটির দিকে তাকিয়ে রইল আর্থার। ফলাটা তিনকোনা, হাতলটা ক্রুশ আকারের, যীশুর মূর্তি খোদাই করা।
‘সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সে হোটেল সিকিউরিটির খোঁজ করছিল,’ ব্যাখ্যা দিল পাভোত্তি। ‘আমার এক লোককে দেখে বলল আপনার সাথে দেখা করতে চায়। তারপর আমার লোকের হাতে ড্যাগারটা তুলে দেয় সে। ড্যাগার সম্পর্কে কি যেন বলতে চাইছে সে আপনাকে। আপনাকে আমরা বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু-’
ফলাটায় আঙুল ছুঁইয়ে ধার পরীক্ষা করতে গেল আর্থার। গুঙিয়ে উঠল। কেটে গেছে আঙুল, এক ফোটা রক্ত বেরুল। ‘ওকে ওপরে পাঠিয়ে দাও, কেমন? আর ড্যাগারটা তোমার কাছেই থাকুক।’ বলল সে ধারাল ছুরিটা পাভোত্তির হাতে দিয়ে। তারপর রওনা হয়ে গেল লিফটের দিকে।
নিজের স্যুইটে ফেরার পথে বারবার হাত ঘষল আর্থার। রক্ত লেগে চটচটে হয়ে গেছে। শিউরে উঠল সে। ছেলেবেলা থেকে ছুরি-কাঁচিতে দারুণ ভয় আর্থারের। ইস্পাতের ছুরি চামড়া ভেদ করে মাংসের গভীরে ঢুকে গেছে, এমন দৃশ্য কল্পনা করলেও ওর বমি এসে যায়। এমন যন্ত্রণা নিশ্চয়ই সহ্যের অতীত। যীশুকে যেভাবে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছে…আবার শিউরে উঠল আর্থার। যীশু বা ধর্ম-কর্ম পালনের প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই আর্থারের। তার কাছে ধর্ম মানে স্রেফ একটা সাপ্তাহিক প্রার্থনা সভা। এ নিয়ে কখনও গভীরভাবে চিন্তাও করেনি। আর দু’হাজার সালে ধর্ম নিয়ে মাতামাতিটাকে তার কাছে মনে হয় নিতান্তই অযৌক্তিক।
ঘরে নেই __ চিরকুট রেখে গেছে। ডিনারের সময় ফিরবে। টেবিলে কিছু টেলেক্স মেসেজও আছে। ওগুলো মাত্র পড়া শুরু করেছে আর্থার, নক্ হলো দরজায়। দরজা খুলল সে। বাদামী আলখেল্লা আর স্যান্ডেল পায়ে এক তরুণ সন্ন্যাসীকে নিয়ে এসেছে পাভোত্তি। লোকটির চেহারায় শিশুসুলভ সারল্য, বেশ সুদর্শন। তবে তাকে খুব আড়ষ্ট এবং উদ্বিগ্ন লাগল। বুড়ো মানুষের হতাশা আর ক্লান্তি ফুটে আছে চোখে।
এক পাশে সরে লোকটিকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিল আর্থার, হাত তুলল পাভোত্তির দিকে তাকিয়ে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকটা অস্বস্তিভরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেল।
‘ভয় নেই,’ তাকে আশ্বস্ত করল আর্থার। ‘কোন সমস্যা হবে না।’
হাসার চেষ্টা করল সন্ন্যাসী। ‘আমি ব্রাদার ডেভিড,’ স্পষ্ট উচ্চারণে ইংরেজীতে বলল সে। ‘সুবিয়াকো থেকে এসেছি।’
‘আমার হাতে সময় কিন্তু খুব কম,’ একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল আর্থার।
‘আমি বেশি সময় নেবও না,’ বলল সন্ন্যাসী। ‘আমি যা বলতে এসেছি তা আপনার বিশ্বাস হবে কিনা জানি না। তবে আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করতেও বলছি না।’ একটু বিরতি দিল সে। ‘কতদিনের জন্যে রোমে এসেছেন মি. আর্থার?’
‘কাল চলে যাচ্ছি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সন্ন্যাসী। ‘কালকের যাত্রাটা বাতিল করুন। আমার সাথে এক জায়গায় চলুন। আমাকে ফাদার ডি কার্লো নামে এক সন্ন্যাসী পাঠিয়েছেন। ওঁর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?’ শেষ প্রশ্নে রীতিমত আবেদন ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।
‘না। আমি মানে ঠিক-
‘বাইরে যাবার মত অবস্থা নেই ডি কার্লোর। বুড়োমানুষ তার ওপর ভগ্নস্বাস্থ্য। ওঁকে আপনার সাহায্য করতেই হবে। কারণ গোটা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর ওপরে। কথাটা কি খুব বেশি ইয়ে হয়ে গেল—মানে, কি যেন শব্দটা?’
‘নাটকীয়?’
‘জ্বী। জ্বী। তবে সব কথা খুলে বললে হয়তো আমাকে পাগল ঠাউরে বসবেন। আপনার কাছে অনুরোধ একটাই-একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। ওটা পড়ন। পড়ার সময় মনে হতে পারে পাগলী এক বুড়ির আবোল-তাবোল লেখা পড়ছি, আসলে তা নয়।’ একটু থেমে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি ধর্ম-কর্ম করেন, মি. আর্থার?’
‘শুধু রোববারে গির্জায় যাই,’ জবাব দিল আর্থার। অবাক হয়ে ভাবল কথাটা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে কেন বলল সে। ‘আপনি প্রটেস্টান্ট?’