আহ্, নামোই না। মজা দেখবে।
বিনাবাক্যব্যয়ে একান্ত অনুগত দাসের মত লুঙি পরেই বাথটাবে নেমে পড়লাম আমি।
বিলটু বলল, ডুব দাও। চোখ বন্ধ করে।
আমি এক হাতে নাকে আঙুল টিপে ধরে মাথা ডুবিয়ে দিলাম পানিতে। হঠাৎ ছ্যাত ছাত শব্দ শুনে চোখ মেললাম। দৃশ্যটা দেখে ভয়ে আত্ম উড়ে গেল। বিলটু জ্বলন্ত মোমবাতিটা উল্টো করে ধরে আছে, মোম গলে পড়ছে পানিতে আর ছ্যাত ছাত শব্দ হচ্ছে। আর বিরাট এক আরশোলা গরম মোমের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাণপণে সাঁতার কাটছে বাথটাবে। নিচ থেকে ওটাকে দেখতে বিকট এবং ভয়ানক লাগছে। বিলটুর দাত বের করা মুখখানাও কিম্ভুতকিমাকার লাগল।
আরশোলাকে আমি ভয় পাই যমের মত। মুখ হাঁ করে চিৎকার করতে যেতে নাকের মধ্যে গড়গড় করে পানি ঢুকে গেল, খাবি খেয়ে লাফিয়ে উঠলাম আমি। নামতে গিয়ে পিছলা বাথরুমে পা পিছলে আলুর দম হয়ে গেলাম। মোজাইক করা মেঝেতে ভীষণভাবে ঠুকে গেল মাথাটা। পরক্ষণে কপালের কাছটা জ্বলে উঠল ভীষণভাবে। চেয়ে দেখি বিলটু হাসি মুখে জ্বলন্ত মোমবাতিটা উল্টো করে ধরে আছে আমার মুখের ওপর, ফোটায় ফোটায় গরম মোম গলে পড়ছে।
আর সহ্য হলো না। শুয়ে শুয়ে ল্যাং মেরে দিলাম বিলটুর পায়ে। প্যাকাটি বিলটু লাথি খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেল আমার পাশে। মোমটা ছিটকে পড়ল বাথটাবের এক কোণে। বিদ্যুৎগতিতে ওটা তুলে নিয়ে বিলটুর যন্ত্রণায় হাঁ করা মুখে ঠেসে ধরলাম। বিকট গলায় চিৎকার করে উঠল বিলটু আল জিভে জ্বলন্ত শিখার ছ্যাকা খেয়ে। আমি দুহাতে চেপে ধরলাম ওর মুখ যাতে আর চিকার করতে না পারে। বিলটু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল, পা ছুঁড়ল কাটা মুরগীর মত, তারপর স্থির হয়ে গেল। বিলটুর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। গাজলা আর রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে হাত। রাগে আর ব্যথায় শরীর তখনও কাঁপছে আমার। শয়তানটা অজ্ঞান হয়ে আছে না মারা গেছে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছেই হলো না। বিলটুর যে দশা আজ করেছি আমি, সোবহান সাহেব এসে দুটুকরো করে ফেলবেন আমাকে। কাজেই পালাতে হবে। ঢাকা শহর ছেড়ে দূরে, অনেক দূরে। কেউ যেখানে আমার খোঁজ পাবে না কখনও।
০২.
বিলটু সম্ভবত মারা যায়নি। কারণ সোবহান সাহেবের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসার পর কোন পত্রিকায় শ্বাসরোধ হয়ে শিশু মৃত্যুর কোন খবর আমার চোখে অন্তত গত পনেরো দিনে পড়েনি। বলতে ভুলে গেছি, গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। যাহোক, প্রথম কটা দিন খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এখনও যে নির্ভয়ে আছি তা বলব না। বলা যায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বিলটুদের বাসা থেকে পালানোর সময়ে আমার আগের জমানো টাকা আর বিলটুর গলা থেকে দুভরি ওজনের সোনার চেনটা নিয়ে এসেছি। চেন বা হাটা মফস্বলের এক সোনার দোকানে অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি করে সেই টাকায় এখনও চলছি। ঠিক করেছি এ দেশে আর থাকব না, সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে যাব। ওখানে কোন কাজ জুটিয়ে নেব। বিচিত্র ধরনের কাজের অভিজ্ঞতার তো কমতি নেই আমার। এখানে থাকা আমার জন্য ঝুঁকি। কারণ বিলটুর যে দশা করে এসেছি, তাতে সাবহান সাহেব প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না। কে জানে গোপনে আমাকে পুলিশ খুঁজছে কিনা। তাই বড় শহর বাদ দিয়ে শুধু মফস্বল শহরগুলোতে ঘাপটি মেরে থাকার চেষ্টা করছি। আপাতত মঠবাড়িয়া শহরে আছি। এখান থেকে নদী পথে মংলা চলে যাব। ওখান থেকে জাহাজে চড়ে হুগলি পগার পার হব।
মঠবাড়িয়ায় আগে বাস চলত না, এখন চলে। আমি সেদিন বাসে চড়ে বড় মাউছ্যা নামে একটা জায়গায় যাচ্ছি, ভর ভরন্তি বাসে, আমার ঠিক সামনের সিটে এক কামলা শ্রেণীর মহিলা উঠল, কোলে নদশ মাসের বাচ্চা।
আমাকে সিগারেট খেতে দেখে সে ভয়ানক কুটি করল। পাত্তা দিলাম না। মহিলাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে উদাস দষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম বাইরের দিকে। মহিলা সিটে বসে বা কাধে শোয়াল তার বাচ্চাকে, আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগল। বাচ্চাটার পা ঝুলে রইল তার মার বুকের ওপর, মাথাটা কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝখানে। কালো, স্বাচ্ছ চোখ মেলে জুল জুল করে তাকিয়ে থাকল সে আমার দিকে। খোদা জানে এই খুদে মানুষটা কি ভাবছে মনে মনে। আর তখুনি আমার ভেতরে দুষ্ট বুদ্ধিটা জেগে উঠল।
আমি বসে আছি বাসের একেবারে পেছনের সিটে, সামনে যাত্রীদের কালো কালো মাথা। আড়চোখে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকালাম। না, কেউ আমার দিকে তাকিয়ে নেই। ঠিক এই সময় বাচ্চাটা তার মধুরঙা মুখখানা খুলল হামি দিতে। আর সাথে সাথে জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠেসে ধরলাম বাচ্চাটার ছোট্ট, গোলাপী জিভে।
বেশ বেশ!
যদি আপনি থাকতেন ওখানে! এমন ভয়ানক চিৎকার জীবনেও শুনিনি আমি; যন্ত্রণা আর ভয়ে বিকট গলায় কেঁদে উঠল বাচ্চা। আমার গায়ের রোম পর্যন্ত বাড়া হয়ে গেল। সাথে সাথে সিগারেটটা পায়ের নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে ফেললাম।
বাচ্চার হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকারে হতভম্ব হয়ে গেল মা। যাত্রীরা কি হয়েছে? কি হয়েছে? বলতে লাগল। বাচ্চা তখনও সমানে চিৎকার করেই চলেছে। আমিও সহানুভূতিশীল হয়ে জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? বাচ্চার মা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি সন্তানের কান্নার কারণ। সে বাচ্চার হাত দেখছে, পা দেখছে, জামা উন্টে পেট দেখছে। বাচ্চা ওদিকে তারস্বরে কেঁদেই চলেছে। এমন সময় ব্রেক কষে থেমে গেল বাস। কি ব্যাপার? না, গন্তব্যে পৌঁছে গেছি আমরা। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল যাত্রীদের মাঝে কে আগে নামবে তাই নিয়ে। এখান থেকে অনেকেই লঞ্চে দূরদূরান্তে যাত্রা করবে। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে আমিও আলগোছে নেমে পড়লাম। নামার ঠিক আগের মুহূর্তে শুনতে পেলাম বাচ্চার মা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে, খোদারে, মোর মনুর মুখে কেডায় জানি আগুন চাইপা ধরছে। আমার চলার গতি দ্রুত হলো। এখানে একটা নির্জন জায়গায় আমার আরেকটা গোপন ঘাঁটি আছে। ওখানে আমার কিছু মাল-পত্র আছে। ওগুলো নিয়ে আসতেই যাচ্ছি। তারপর আজ রাতে কেটে পড়ব এখান থেকে।