রিশি কয়েক মুহূর্ত টিরিনার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল। স্মৃতি মুছে ফেলার যে ওষুধটা দেওয়া হয়েছে সেটা কাজ করতে শুরু করেছে।
টিরিনা এক ধরনের গভীর ভালবাসা নিয়ে রিশির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটিকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্য সে এসেছে। সে নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করবে। বুক আগলে রক্ষা করবে।
মানুষের মতো অসহায় আর কে এই জগতে?
» ০২. ঘৃণার সঙ্গে বসবাস
নিশি গোল কোয়ার্টজের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নির্দিষ্ট জিনের কিছু বেস পেয়ারকে পরিবর্তন করে আজকাল যে কোনো মানবীকে সুন্দরী করে দেওয়া যায় বলে সৌন্দর্যের গুরুত্বটি কমে এসেছে-তারপরও একটু ভালো করে লক্ষ করলেই বোঝা যায় নিশির। সৌন্দর্যটি অন্যরকম। তার কিশোরীর মতো ছিপছিপে দেহ, সেখানে চলাচলে এক ধরনের। লাবণ্য, আকাশের মতো নীল চোখ, লালচে চুল এবং কোমল ও মসৃণ তুক। তার ভেতরে এক ধরনের সতেজ আত্মবিশ্বাস, যেটি সব সময়েই চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে থাকে। তার। অনুভূতি সব সময়েই খুব চড়া সুরে বাঁধা থাকে, এই মুহূর্তে যেটি উত্তেজনায় প্রায় আকাশছোঁয়া হয়ে আছে। তার সমস্ত মুখমণ্ডল প্রচণ্ড ক্রোধে রক্তাভ এবং অপ্রতিরোধ্য এক ধরনের আক্রোশে তার শরীর অল্প অল্প কঁপছে। নিশি এক ঝটকা মেরে তার মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলোকে পেছনে সরিয়ে ঘরের মাঝামাঝি বসে থাকা অণ্ডনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার এবং আমার মাঝে যে সম্পর্ক সেটা সম্ভবত পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক।
অশুন নিশির আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করা স্বামী। অশুন সুদর্শন-শক্ত-সমর্থ এক যুবক। তার বয়স নিশির বয়সের কাছাকাছি, মানসিক কাঠামো, বুদ্ধিমত্তা, আত্মবিশ্বাস এমনকি কথা বলার ভঙ্গিও দুজনের প্রায় একই রকম। দুজন এত কাছাকাছি ধরনের মানুষ হবার পরও কোনো একটি বিচিত্র কারণে একজন আরেকজনকে গ্রহণ করতে পারে নি। এই গ্রহণ করতে না পারাটুকু যুদি মৃদু অপছন্দের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকত তা হলে একটি কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি, তারা একজন আরেকজনকে সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে। প্রাচীনকালে পরিবারের কাঠামোটির খুব গুরুত্ব ছিল, পরিবার হিসেবে টিকে থাকার একটি বড় শর্ত ছিল সন্তান পালন করা। তখন একজন পুরুষ ও রমণীর পক্ষে পরস্পরকে এত তীব্রভাবে ঘৃণা করে একসাথে বসবাস করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন পরিবেশটি অন্যরকম। নিশি এবং অশুন যে একসাথে স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে বসবাস করছে তার একটিমাত্র কারণ হচ্ছে পরস্পরের প্রতি অকল্পনীয় এক ধরনের ঘৃণী। এই ঘৃণা এত তীব্র এবং গভীর যে নিজের অজান্তেই তারা সেই ঘৃণাকে ভালবাসতে শুরু করেছে, লালন করতে শুরু করেছে। দুজন দুজনকে ছেড়ে গেলে এই তীব্র ঘৃণাটুকু হারিয়ে যাবে বলেই হয়তো ভারা আর আলাদা হয়ে যেতে পারছে না।
নিশি তীব্র দৃষ্টিতে অণ্ডনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তোমাকে আমি একদিন বিয়ে করেছিলাম।
অশুন একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, কেন? বিশ্বাস না করার কী আছে?
তুমি বলতে চাও তোমাকে সত্যি আমি একসময় পছন্দ করতাম? তোমাকে আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভালবেসেছিলাম?
না। অশুন মাথা নাড়ল, বলল, তুমি আমাকে কোনো দিন ভালবাস নি, আমি এই ব্যাপারটি তোমাকে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।
নিশি তার সুন্দর রু দুটি কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই ব্যাপারটিতে এত নিশ্চিত কেমন করে হলে?
কারণ আমাকে বা অন্য কোনো মানুষকেই তোমার ভালবাসার ক্ষমতা নেই। প্রকৃতপক্ষে তোমার মস্তিষ্কের গঠনে কাউকে ভালবাসা সম্ভব নয়।
নিশি কষ্ট করে নিজের ক্রোধকে সংবরণ করে বলল, তাই যদি সত্যি হয় তা হলে তোমাকে কেন আমি একদিন বিয়ে করেছিলাম?
কৌতূহল। অশুন মাথা নেড়ে বলল, তুমি একজন মেয়ে, পুরুষ কেমন করে আচরণ করে সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা ছিল না। তাই তুমি কৌতূহলী হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলে।
আর তুমি? নিশি তীব্র স্বরে বলল, আর তুমি কেন আমাকে বিয়ে করেছিলে?
অশুন আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে বলল, ভুল করে। আমি তোমাকে ভুল করে বিয়ে করেছিলাম। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে তোমার ভেতরে এক ধরনের সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল, সে কারণে আমি তোমার প্রতি এক ধরনের জৈবিক আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম।
এখন সেই সম্মোহনী ক্ষমতা নেই? সেই জৈবিক আকর্ষণ নেই?
না নেই। অশুন প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমার কাছে তুমি আর একটি ঘিনঘিনে বিষাক্ত সাপের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। একটা বিষাক্ত সাপকে আমি যেরকম বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পিষে মেরে ফেলতে পারি ঠিক সেরকম তোমাকে পিষে মেরে ফেলতে অামার একটুও দ্বিধা হবে না।
নিশি নিচু গলায় হিসহিস করে বলল, তা হলে মেরে ফেলছ না কেন?
অশুন হা-হা করে হেসে বলল, আইনের ভয়ে। যদি আইনের কোনো বাধা না থাকত তা হলে এতদিনে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে খুন করে ফেলতাম। আজ থেকে এক শ বছর আগে হলে আমি নিশ্চিতভাবে তোমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতাম! তোমার খুব সৌভাগ্য যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বাবহার করে মহিলাদের শারীরিক শক্তি পুরুষের সমান করে ফেলা হয়েছে। তা না হলে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে নির্দয়ভাবে আঘাত করতাম।
নিশি বিস্ফারিত চোখে অশুনের দিকে তাকিয়ে রইল। অশুন মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার প্রিয় ফ্যান্টাসি কী জান?