দ্রুমান রিশিকে টেনে ট্রলির উপরে শুইয়ে বলল, এইখানেও সেই একই ব্যাপার। একজন মানুষ একা একা বিশ বছর থেকে এখানে আছে, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনকে ব্যবহার করছে জেনারেটর চালানোর জন্য, শক্তির কোনো অপচয় নেই। একেবারে নিখুত একটা প্রক্রিয়া, আমি কীভাবে করেছি এটা তোমাদের দেখা দরকার। এইজন্য আমি নিহিলিয়ান বিষটা পছন্দ করি। তোমাদের শরীর পুরোপুরি অচল, কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছ, তুমি শুনতে পাচ্ছ, বুঝতে পারছ। কী চমৎকার!
দ্রুমান প্রথমে রিশিকে তারপর টিরিনাকে ট্রলিতে করে ঠেলে ঠেলে এক পাশে একটা বন্ধ ঘরের সামনে নিয়ে আসে। ঘরের বড় তালা খুলতেই একটা বোটকা গন্ধ পেল রিশি। সে তার মাথা ঘুরাতে পারছে না, তাই এখনো কিছু দেখতে পাচ্ছে না। দ্রুমান রিশি আর টিরিনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঠুলিটা ভাজ করে তাদেরকে আধশোয়া অবস্থায় নিয়ে আসতেই তারা পুরো দৃশ্যটি দেখতে পেল, একটা ভয়ংকর আতঙ্কে তারা চিৎকার করে উঠত কিন্তু তাদের শরীর পুরোপুরি অবশ বলে তারা শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।
ঘরের মাঝামাঝি জেনারেটরটি দাঁড় করানো আছে তার চারপাশে প্রায় পঞ্চাশ জন নগ্ন মানুষ শুয়ে আছে। মানুষগুলো নিশ্চয়ই অচেতন, কারণ তাদের কোথাও প্রাণের স্পন্দন নেই, শুধু তাদের পাগুলো জেনারেটরের মূল শ্যাফটটাকে যন্ত্রের মতো ঘুরিয়ে যাচ্ছে। প্রমান এক ধরনের উচ্ছসিত গলায় বলল, দেখেছ আমার ইঞ্জিন? আমি এটার নাম দিয়েছি দ্রুমান ইঞ্জিন।
সে কাছাকাছি একজন মানুষের কাছে গিয়ে বলল, ভালো করে তাকিয়ে দেখ, এই যে এই টিউব দিয়ে তার জন্য পুষ্টিকর তরল আসছে। এই টিউবটা নাকের ভেতর দিয়ে সরাসরি ফুসফুসে চলে গেছে। আমি এটা দিয়ে একেবারে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সাপ্লাই দিই। শরীরের যা বর্জ্য সেগুলো এই টিউব দিয়ে আমি বের করে নিয়ে আসি। ডান দিকে তাকিয়ে দেখ আমার সিনথেজাইজার বর্জ্য থেকে সবগুলো যৌথমূল আলাদা করে আবার নূতন করে পুষ্টিকর তরল তৈরি করা হয় সেটা আবার তাদের শরীরে চলে আসছে। একটা পরিপূর্ণ সিস্টেম, বাইরে থেকে বলতে গেলে আমার কিছুই লাগছে না।
দ্রুমান তার জেনারেটর ঘরের ভেতর ঘুরতে থাকে, কোনো কোনো মানুষের চোখের পাতা তুলে পরীক্ষা করে সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে আবার রিশি আর টিরিনার কাছে ফিরে আসে, তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ মানুষগুলো এটা কেন করছে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। দ্রুমান নিজেই তার চোখে-মুখে প্রশ্ন করার ভঙ্গি নিয়ে এসে বলল, আর এই প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে আমার সাফলা! আমার আবিষ্কার।
দ্রুমান কাছাকাছি এসে একজনের হাতটা একটু উপরে তুলে আবার ছেড়ে দিতেই সেটা নির্জীবের মতো পড়ে যায়, ঈমান বলল, দেখেছ? হাতগুলো পুরোপুরি অচল। আস্তে আস্তে শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গেছে। জেনারেটরের শ্যাফটটা ঘোরানো হচ্ছে পা দিয়ে, হাতের কোনো প্রয়োজন নেই তাই আস্তে আস্তে হাতগুলো অচল হয়ে যাচ্ছে। এই জেনারেটর চালানোর জন্য আমার দরকার একেবারে সুস্থ সবল নীরোগ মানুষ। এখানে সবাই সুস্থ সবল। আর নীরোগ। শুধু সুস্থ সবল আর নীরোগ নয়, তারা অসম্ভব সুখী মানুষ। তোমরা দেখতে পাচ্ছ তাদের মুখে এক ধরনের পরিতৃপ্তির হাসি? দেখেছ?
খুব ধীরে ধীরে রিশির চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার ভেতরেও সে দেখতে পেল কাছাকাছি শুয়ে থাকা নগ্ন মেয়েটির মুখে সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি, সেই মুখে কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন নেই। দ্রুমানের নিজের মুখেও এক ধরনের পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা এর সবই তো আসলে আমাদের মস্তিস্কের এক ধরনের প্রক্রিয়া। আমি সেই প্রক্রিয়াটাকেই নিয়ন্ত্রণ করছি। এদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু জায়গা পাকাপাকিভাবে নষ্ট করে দিয়েছি যেন তারা আর কোনো দিন জেগে উঠে কারো কাছে অভিযোগ করতে না। পারে। কিছু কিছু জায়গা একটু পরিবর্তন করে দিয়েছি যার কারণে তাদের মুখে এরকম আনন্দের হাসি। তারা খুব আনন্দের সাথে এই কাজটা করছে। তাদের ভেতরে কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই, হিংসা নেই, রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, তারা খুব সুখে আছে। মাঝে মাঝে তাদেরকে দেখলে আমার এক ধরনের হিংসা হয়। মনে হয় আহা আমিও যদি তাদের মতো সুখী হতে পারতাম, আনন্দিত হতে পারতাম।
দ্রুমানের মুখে সত্যিই এক ধরনের বিষণ্ণতাব ফুটে ওঠে। তাকে দেখে মনে হতে থাকে সত্যি বুঝি এই মানুষগুলোর মতো সুখী হবার জন্য তার ভেতরে এক ধরনের ব্যাকুলতার জন্ম হয়েছে। সে রিশির চোখের পাতা টেনে চোখের মণিটা একনজর দেখে বলল, নিহিলিয়ানের কাজ শুরু করেছে। এখন তোমরা অচেতন হয়ে গেছ। তোমরা আর আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমি একা একা কথা বলতে পারি। আমি বিশ বছর থেকে নিজের সাথে কথা বলছি। নিজের সাথে কথা বলার থেকে চমৎকার ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এর মাঝে কোনো বিরোধ নেই, তর্কবিতর্ক নেই। তোমরা ব্যাপারটা চেষ্টা করে দেখলে পারতে। এখন অবিশ্যি দেরি হয়ে গেছে, কারণ তোমরা আর কোনো দিন চেতনা ফিরে পাবে না। এক ধরনের ঐশ্বরিক আনন্দ দিয়ে আমি তোমাদের প্রমান ইঞ্জিন তৈরি করে ফেলব।
দ্রুমান টিরিনার ট্রলিটা ঠেলে ঘরের এক কোনায় নিতে নিতে বলল, আমার এই ইঞ্জিন ঘরেই সবকিছু। অস্ত্রোপচারটাও এই ঘরে করি। অবিশ্যি অস্ত্রোপচারের কাজটা খুব সহজ। আমি এই হেলমেটটা তোমাদের মাথায় পরিয়ে দেব মান একটা হেলমেট তুলে দেখাল, তারপর বলল, হেলমেটের নয়টা জায়গায় নয়টা ভ্রু আছে সেগুলো ঘুরিয়ে টাইট করতে হয়, বাস সাথে সাথে কাজ শেষ। ভিতরে কয়টা লিভার আছে, সেগুলো মস্তিষ্কের ঠিক ঠিক জায়গায় ফুটো করে কিছু পরিবর্তন করে দেয়। অত্যন্ত চমৎকার একটা যন্ত্র! এটা আমাকে তৈরি করে দিয়েছে ডক্টর নিশিনা–ঐ দেখ ডান দিক থেকে তিন নম্বর জায়গায় শুয়ে নগ্ন দেহে হাসিমুখে সে কাজ করে যাচ্ছে। বেচারা বুঝতেই পারে নি আমি তার ওপরে সেটা প্রথমবার ব্যবহার করব। কিছু কিছু মানুষ জীবনের জটিলতাগুলো বুঝতে পারে না।