ঠিক তখন তার আগ্নেয়াস্ত্রটির কথা মনে পড়ল। নিচু হয়ে সেটি তুলে নিয়ে দরজার দিকে লক্ষ করে এক পশলা গুলি করল। বাইরে নিরাপত্তাকর্মীদের ভ্রাতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পায় সে, এগিয়ে আসতে সাহস করছে না কেউ। আরো কিছুক্ষণ সময় পেয়েছে সে। আবার সে ঝুঁকে পড়ল কী-বোর্ডের ওপর।
খুব ধীরে ধীরে নিরাপত্তা ব্যূহটি সরে যাচ্ছে। সুহান বিস্ফারিত চোখে দেখতে পায় ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কটি উন্মুক্ত হয়ে আসছে তার সামনে। আর অল্প কিছু সময় পেলেই সে বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদনটুকু পাঠিয়ে দিতে পারবে বাইরে।
দরজায় আবার সে হুঁটোপুটি শুনতে পায়, নিরাপত্তাকর্মীরা আবার এগিয়ে আসছে তার কাছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সুহান আবার এক পশলা গুলি করার চেষ্টা করল, মাঝপথে হঠাৎ গুলি থেমে যায়, গুলি শেষ হয়ে গেছে। তার কাছে বাড়তি ম্যাগজিন নেই, বিষয়টি বুঝতে বেশি সময় লাগল না, সাথে সাথে নিরাপাকর্মীরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল।
চোখের কোনা দিয়ে সুহান দেখতে পেল নিরাপত্তাকর্মীরা এগিয়ে আসছে। সবার সামনে রিগা, তার হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, যেটা দিয়ে সে এর আগে আরো একজনকে হত্যা
করেছিল।
সুহানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, কী হবে এখন? ঠিক সেই মুহূর্তে মনিটরে দুর্বোধ্য সংখ্যার প্লাবন বন্ধ হয়ে একটা লেখা ফুটে ওঠে নিরাপত্তা ব্যহ অপসারিত, উন্মুক্ত নেটওয়ার্ক।।
নেটওয়ার্ক উন্মুক্ত হয়েছে, তার আর মাত্র একটি মুহূর্ত সময় দরকার। মাত্র একটি মুহূর্ত। সুহান কাপা হাতে কী-বোর্ডের তিনটা অক্ষর স্পর্শ করল, সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের গোপন প্রতিবেদনটি পৃথিবীর মূল নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে যায়, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সেটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি আর সেটি আটকে রাখতে পারবে না।
সুহান মাথা ঘুরিয়ে রিগার দিকে তাকাল, তার মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি। রিগা উন্মুক্ত মানুষের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ক্যাটাগরি-বি. জানোয়ার। প্রথম দিনেই তোকে আমার খুন করা উচিত ছিল।
সুহান হাসল, বলল, সেজন্য এখন খুব দেরি হয়ে গেছে।
রিগা হিংস্র গলায় বলল, না। হয় নি। তারপর সে তার ছোট আগ্নেয়াস্ত্রটা তুলে গুলি করল, মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে গেল সুহানের রক্ত ছিটকে এসে লাগল রিগার চোখে-মুখে। প্রাণহীন দেহটা চেয়ার থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়, উন্মুক্ত রিগা তবু থামে, হিংস্র দানবের মতো গুলি করতে থাকে তার মৃতদেহকে।
নিরাপত্তাকর্মীদের ঠেলে কিরি হঠাৎ ছুটে এল। চিৎকার করে বলল, থাম। খাম রিগা–
কেন? কী হয়েছে?
কিরি এগিয়ে এসে মৃতদেহের পাশে ঝুঁকে পড়ে সেটা পরীক্ষা করে বলল, এটা সুহান।
রিগা চিৎকার করে উঠল, সুহান না?
না। সুহানের মতো দেখতে একটা রবারের মাস্ক পরেছে—খুলে এসেছে এখন।
রিগাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়। তা হলে ভেতরে ঢুকল কেমন করে?
সুহানের কার্ডটা নিয়ে এসেছে। জিনেটিক কোডিং করার জন্য আঙুলে একটা কৃত্রিম ত্বক তৈরি করেছে, এই দেখ সুহানের রক্ত আছে সেখানে, সুহানের মতো কণ্ঠস্বর করার জন্য ভোকাল কর্ডে একটা ইমপ্লন্ট!
বিগ বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী করতে এসেছে এখানে?
কিরি মনিটরে তাকিয়ে বলল, কী একটা ফাইল নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দিয়েছে।
কিসের ফাইল?
কিরি বলল, আমি জানি না। আমি এসব বুঝি না। মনে হয় দশম মাত্রার গোপনীয়।
রিগা হুঙ্কার দিয়ে বলল, বের কর কী ফাইল।
কেমন করে বের করতে হয় আমি জানি না।
রিগা চিৎকার করে বলল, সিস্টেমের লোক কোথায়? এক্ষুনি আসতে বলে। এক্ষুনি।
সেটা বের করার তখন কোনো প্রয়োজন ছিল না, সারা পৃথিবীতে ততক্ষণে বিজ্ঞানীদের গোপন প্রতিবেদনটা পৌঁছে গেছে। ক্যাটাগরি-বি. মানুষের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করা। হয়েছিল সেটা প্রচারিত হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর মানুষ হতবিহ্বল হয়ে মাত্র বুঝতে শুরু করেছে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ কী ভয়ংকর একটি ষড়যন্ত্র করেছিল, কী অমানবিক এবং নিষ্ঠুর সেই ষড়যন্ত্র।
সুহান থরথর করে তার চেয়ারে বসে কাঁপছিল। রিয়ানা তাকে ধরে রেখে বলল, শান্ত হও সুহান। শান্ত হও।
সুহান বলল, কেমন করে শান্ত হব। আমি স্পষ্ট দেখেছি রিগা আমার মাথায় গুলি করল, মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে গেল আমার।
তোমার নয়, থিরু। তোমার মতো একটা রবারের মুখোশ পরে তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে গিয়েছে। তুমি এখানে বসে তার সাথে নিজেকে সমন্বিত করেছ। খিরু নিজেকে সুহান ভেবেছে। সুহান হয়ে তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে গেছে।
সুহান শূন্য দৃষ্টিতে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সব জানি রিয়ানা, সব জানি কিন্তু তারপরেও বিশ্বাস হয় না। তুমি বিশ্বাস করবে না রিয়ানা কী ভয়ংকর সেই অনুভূতি।
মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কী ভয়ংকর একটি শূন্যতা এসে গ্রাস করে—
কিন্তু সেটি সত্যি নয় সুহান। তুমি বেঁচে আছ—
সুহান রিয়ানার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, মি আমার নিজের কথা বলছি না রিয়ানা। আমি থিরুর কথা বলছি! মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তার বুকের ভেতর যে ভয়াবহ শূন্যতা ছিল, যে দুঃখ ছিল সেটি তুমি কল্পনা করতে পারবে না। পৃথিবীর কেউ পারবে না।
রিয়ানা মাথা নেড়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, নরম গলায় বলল, আমাদের কিছু করার ছিল না সুহান। তোমাদের দুজনের একজনকে আমরা হারাতাম। আমরা ভেবেছিলাম তোমার কথা, থিবু কিছুতেই রাজি হল না, সে বলল নেটওয়ার্কের ভেতরে ঢুকে যাবার বিষয়টি সে অন্য কারো সাথে সমন্বিত করে করতে চায় না, নিজে করতে চায়।