অবশ্যই জানাব। সুহান সরল মুখ করে হেসে বলল, তুমি এত বড় ডাক্তার, আমার জীবন বাঁচিয়েছ, তোমাকে যদি না জানাই তা হলে কাকে জানাব?
সুহানের কথায় কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে ডাক্তার মানুষটা খুব সঙ্কুচিত হয়ে গেল।
সুহান বাসায় এসে দীর্ঘ সময় চুপচাপ জানালার কাছে বসে থাকে। সে আগামীকাল কাজে ফিরে যাবে, আগামীকাল হবে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। সে কি পারবে তার ওপর দেওয়া এত বড় দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে? সে কি সেখান থেকে বেঁচে আসতে পারবে? তার চোখের সামনে বারবার একটি দৃশ্য ভেসে আসে, একজন মানুষ শান্তি মুখে কী-বোর্ডের সামনে বসে কাজ করছে, আর রিগা একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে তাকে গুলি করছে—একবার দুইবার অনেকবার। সুহান নিজের অজান্তেই শিউরে ওঠে, জোর করে সে চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করে দেয়।
সুহান উঠে দাঁড়াল, ঘরের ভেতরে কয়েকবার পায়চারি করে সে তার ভিডিফোনটা তুলে নেয়, তার হঠাৎ কোনো একজন আপনজনের সাথে কথা বলার ইচ্ছে করছে। সে ভিডিফোনে ডায়াল করল, তার অনাথাশ্রমের ডিরেক্টর লারার সাথে সে কথা বলবে। ডায়াল করতেই স্ক্রিনে লারার ছবি ভেসে ওঠে, সুহানকে দেখে তার মুখ আনন্দোজ্জ্বল হয়ে ওঠে, প্রায় চিৎকার করে বলে, সুহান! তুমি?
হ্যাঁ লারা, আমি।
এতদিন পরে তোমাকে দেখে কী ভালো লাগছে আমার!
সুহান বলল, আমারও খুব ভালো লাগছে।
তুমি নিশ্চয়ই খুব ভালো করছ সুহান। লারা আনন্দিত গলায় বলল, তোমার নিজের ভিডিফোন হয়েছে।
সুহান ম্লান মুখে বলল, সেটা এমন কিছু নয়। তোমাদের কথা বলো লারা। সবাই কেমন আছ?
সবাই—সবাই–লারা একটু ইতস্তত করে বলল, আছে একরকম।
রুরা কেমন আছে সারা?
ভালোই আছে। একটু চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল।
দিনিয়া? দ্রুমা?
দিনিয়া আগের মতোই আছে। কিন্তু দ্রুমা–
সুহান উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে দ্রুমার?
কিছুদিন আগে তার আবার অ্যাটাক হল, মস্তিষ্কের একটা ধমনি ফেটে গিয়েছিল। দু দিন কোমায় ছিল।
সুহান নিচু গলায় বলল, ও।
তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না সুহান। নিজের কাজ করে যাও।
করব। সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, লারা।
বলো।
তুমি রুরাক দিনিয়া কিশি সবাইকে আমার ভালবাসা জানিয়ে দিও।
দেব। নিশ্চয়ই দেব।
তোমার জন্যও অনেক ভালবাসা লারা।
লারা সুন্দর করে হাসল, বলল, তোমার জন্যও সুহান।
ভিডিফোনটা রেখে দিয়ে সুহান আবার নিজের ভেতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। নিঃসঙ্গতাকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে যখন তার জানালার সামনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল তখন সে তার মস্তিষ্কের ভেতর রিয়ানার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, সুহান।
বলো রিয়ান।
কালকে আমাদের সেই দিন।
হ্যাঁ।
তোমার ভয় করছে সুহান?
সুহান একটু হাসল, বলল, আমাদের মস্তিষ্ক সমন্বিত, তুমি তো জান রিয়ানা আমার কেমন লাগছে।
হ্যাঁ, জানি। পুরোটুকু জানি না, অনেকখানি জানি ভয়ের কিছু নেই সুহান। আমরা সবাই তোমার সাথে একসাথে আছি।
সুহান কোনো কথা বলল না। রিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাল তোমার সবচেয়ে গভীরভাবে সমন্বয় করতে হবে থিরুর সাথে। থিরু আমাদের সার্ভার, নেটওয়ার্ক, ডাটাবেস আর সিকিউরিটি এক্সপার্ট।
আমি চেষ্টা করব।
আমার মনে হয় এখন থির সাথে তুমি একটা সেশন কর।
ঠিক আছে। সুহান ডাকল, থিরু। থিরু তুমি কোথায়?
এই যে, আমি এখানে। থিরু তার স্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল, আমি তোমার চোখ দিয়ে দেখতে চাই সুহান।
আমি চেষ্টা করছি।
সুহান তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, কয়েক মুহূর্তের মাঝে থিরুর সাথে সে পুরোপুরি সমন্বিত হয়ে যায়। সুহান দেখতে পায় সে একটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনিটরে নানা ধরনের সংখ্যা খেলা করছে। তার সামনে কী-বোর্ড, কী-বোর্ডে তার আঙুলগুলো যন্ত্রের মতো ছোটাছুটি করছে। সে থিরুর মতো দেখছে, থিরুর মতো শুনছে, থিরু মতো নিশ্বাস নিচ্ছে। নিজের অজান্তেই সে থিরুর সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে যায়।
পরদিন সুহান তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হল খুব ভোরে। আগে সে পাতাল ট্রেনে যাতায়াত করেছে, এখন দীর্ঘদিন সে ঘরে বসে আছে, খরচ নেই কিন্তু বেতনের ইউনিটগুলো নিয়মিত তার অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, বেশ কিছু ইউনিট হয়ে গেছে ভার, ইচ্ছে করলে একটা ট্যাক্সিতে যেতে পারে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ঠিক তখন তার কাছাকাছি একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। খুট করে দরজা খুলে যায় এবং সুহান শুনতে পেল তার মস্তিষ্কে কেউ একজ্জন বলল, উঠে যাও।
সুহান চমকে উঠে বলল, উঠে যাব?
হ্যাঁ।
যদি কেউ দেখে ফেলে?
দেখবে না। কেউ নেই। তোমাকে তথ্যকেন্দ্রে নামিয়ে দিই।
সুহান ট্যাক্সিতে উঠতেই মৃদু গর্জন করে সেটা এগিয়ে যায়।
তথ্যকেন্দ্রের সামনে নামিয়ে দেবার পরও সুহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এর আগে কতবার সে এখানে এসেছে, ভেতরে ঢুকেছে। কাজ করেছে কাজ শেষে বের হয়ে এসেছে। আজ সম্পূর্ণ অনা ব্যাপার, সে ভেতরে ঢুকবে কিন্তু সে জানে না সে বের হতে পারবে কি না। সুহান জোর করে মাথা থেকে চিন্তা দূর করে দিল, বের হতে না পারলে নেই, কিন্তু তার ওপরে যে দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে সে সেটা শেষ করবে। সুহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে তার কার্ডটা হাতে তথ্যকেন্দ্রের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
দরজায় কার্ডটা দেওয়ার সময় হঠাৎ তার হাত কেঁপে উঠল। আজ কি দূরজা খুলবে তার জন্য নিরাপত্তাকর্মীরা কি কোনোভাবে তার মনের কথা জেনে গেছে? কিন্তু না, তারা কেউ জানে না। ঘড়ঘড় শব্দ করে দরজা খুলে গেল, সুহান দেখতে পেল জিনেটিক কোডিং করার জন্য যন্ত্রটা নিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। সুহান একটু এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রের ভেতরে আঙুলটা প্রবেশ করিয়ে দিতেই একটা মৃদু খেচা অনুভব করে, প্রায় সাথে সাথে মনিটরে সুহানের চেহারা ফুটে ওঠে। উপরে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে—