রিয়ানা বলল, ঠিক আছে কুরু। তোমাদের ঝগড়াঝাটি-হইচই পরে হবে। সুহান প্রতিদিন সকালে বের হয়ে কফি হাউসে গিয়ে এক মগ কফি খায়। আজ তার জায়গায় কফি খেয়েছে থিরু। সুহানের এখনো কফি খাওয়া হয় নি—তাকে এক কাপ কফি খাওয়ানো যাক।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি বলল, শুধু কফি নয়, কফির সাথে খাওয়ার জন্য চমৎকার কিছু প্যাষ্ট্রি আনিয়ে রেখেছি। এস সবাই।
পেষ্ট্রি এবং কফি খেতে খেতে সবার সাথে হালকা কথাবার্তা হল। সুহানের সবার সাথে পরিচয় হল মস্তিষ্কের সমন্বয় হয়ে আছে বলে তাদের সবার চিন্তাভাবনার সাথে সে জড়িয়ে আছে, এই প্রথমবার তাদেরকে সে দেখছে। খাওয়া শেষ হবার সাথে সাথেই সবাই কাজে লেগে যায়। সুহানের শরীরের মাপ নেওয়া হয়, চোখের আইরিস, রেটিনার ছবি নেওয়া হয়। মস্তিষ্কের স্ক্যান করা হয়, শরীরের ভেতরকার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ত্রিমাত্রিক ছবি নেওয়া হয়। মস্তিস্কের ভেতরে বসানো ইন্টেগ্রেটেড সার্কিটের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। গলার স্বরে নিখুঁত প্রোফাইল বের করা হয়। সবকিছু যখন শেষ করা হয়েছে তখন অপরাহ্ন হয়ে এসেছে।
রিয়ানা বলল, সুহান, তোমার ফিরে যাবার সময় প্রায় হয়ে এসেছে।
সুহান খোলা জানালা দিয়ে বাইরে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।
রিয়ানা সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি ফিরে যাবার আগে সমুদ্রের বালুবেলায় একটু হাঁটতে চাও?
সুহান উজ্জ্বল চোখে বলল, সময় হবে আমাদের?
অবশ্যই হবে। এস।
সুহান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিয়ানার সাথে সাথে একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সমুদ্রের বালুবেলায় নেমে এল। দুজনে হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, সমুদ্রের ঢেউ এসে ছিঁড়ে পড়ছে, সুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পর বিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আগে কখনো সমুদ্র দেখি নি।
রিয়ানা নরম গলায় বলল, জীবনে প্রথমবার সমুদ্র দেখা অত্যন্ত বড় একটা অভিজ্ঞতা।
আমি একটা অনাথাশ্রমে বড় হয়েছি। তথ্যকেন্দ্রের এই চাকরিটা না পেলে হয়তো অনাথাশ্রমের দেয়ালে কিংবা কোনো একটা ইউরেনিয়াম খনি ছাড়া আর কিছু দেখতামই না।
রিয়ান কোনো কথা না বলে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান নিচু গলায় বলল, অনাথাশ্রমে আমার যেসব বন্ধুবান্ধব আছে তারা কেউ কোনো দিন সেখান থেকে বের হয় নি। পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য দেখে নি। পৃথিবী যে কত সুন্দর তারা জানে না। কারণ তারা ক্যাটাগরি-বি. মানুষ।
রিয়ানা সুহানের কাধ স্পর্শ করে বলল, আমরা তার পরিবর্তন করব সুহান।
সুহান ঘুরে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, কিন্তু কেন পরিবর্তন করে সেটা ঠিক করতে হবে? কেন সেটাই হল না? সুহান হাত দিয়ে সমুদ্রটাকে দেখিয়ে বলল, দেখ এই সমুদ্রষ্টাকে দেখ—কী বিশাল! এই পৃথিবীটা দেখ—কী বিশাল! আর তার মাঝে আমাদের মতো মানুষের কোনো জায়গা নেই—এটা কি হতে পারে?
রিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। বলল, না, সুহান এটা হতে পারে না। এটা হবে না।
কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে। আইন করে ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে—
কিন্তু আমরা কি সেটা হতে দেব? তথ্যকেন্দ্র থেকে আমরা যখন বিজ্ঞানীদের সেই রিপোর্ট বের করে পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেব তখন এক মুহূর্তে পুরো অবস্থাটা পাল্টে যাবে।
সুহান রিয়ানার দিকে তাকাল, আমরা কি পারব রিয়ানা?
রিয়ানা একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, সব এখন তোমার ওপর নির্ভর করছে সুহান।
কিন্তু–কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমি যে তথ্যকেন্দ্র, সার্ভার, নেটওয়ার্ক এসব কিছুই জানি না। আমি কি পারব প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে?
পারবে। কারণ আমরা সবাই তোমার মস্তিষ্কের সাথে সমন্বিত হয়ে থাকব। আমরা সবাই তোমাকে সাহায্য করব।
সুহান বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। পারবে সে নিশ্চয়ই পারবে। সে যদি না পারে তা হলে ক্যাটাগরি-বি. মানুষেরা কখনোই মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না।
রিয়ানা সুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, চলো সুহান আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
চলো।
তোমার মাস্কটা পরে নিয়ে তোমাকে আবার থিরু হয়ে যেতে হবে।
সুহান মাথা নাড়ল। বলল, । চলো আবার থিরু হয়ে যাই।
দুজনে বালুবেলা ধরে হাঁটতে থাকে। সমুদ্রের ঢেউ একটু পরপর আছড়ে পড়ছে কিন্তু সুহান সেটি আর গুনছে না, সে হঠাৎ কেমন জানি আনমনা হয়ে ওঠে।
০৮.
শেষ পর্যন্ত ডাক্তার সুহানকে তার কাজে ফিরে যাবার অনুমতি দিল। তার শরীরের রক্ত, ত্বক, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, মস্তিষ্ক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বলল, তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ সুহান। তুমি এখন তোমার কাজে ফিরে যেতে পার।
কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে সুহানের বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। সে বলল, আমি কাজে ফিরে যেতে পারব?
হ্যাঁ।
কখন যেতে পারব ডাক্তার?
ইচ্ছে করলে কালকেইআমি তোমার সুস্থ দেহের সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি।
অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার।
তোমার মস্তিষ্কের কাগুলোর খবর কী?
এখনো হয়। তবে আমি সেগুলো নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখে গেছি! মাথার ভেতরে কথা হলে আমি সেগুলো শুনেও শুনি না!
ও আচ্ছা। ও আচ্ছা। ডাক্তার একটু ইতস্তত করে বলল, তবুও তুমি যদি কখনো মনে কর আমাদের জানানো দরকার তা হলে আমাদের জানিও।