এই তথ্যটা পৌঁছে দেওয়ার পরদিন থেকে সুহানের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। নিরাপত্তা বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তারা তার সাথে দেখা করতে এলে তাকে একটা শক্তিশালী ভিডিফোন দিয়ে বলে গেল যে কোনো প্রয়োজনে সে এটা ব্যবহার করতে পারবে। হঠাৎ কবে সে যদি তার মস্তিষ্কের ভেতর কোনো কথা শুনতে পায় এবং সেটা ডাক্তারকে জানাতে হয় সে যেন এটা ব্যবহার করতে কোনো দ্বিধাবোধ না করে।
শক্তিশালী ভিডিফোনটা হাতে নিয়ে তার অনাথাশ্রমের রুরাকের কথা মনে পড়ল। তার খুব ভিডিফোনের শখ ছিল—যদি তাদের কারো কাছে ব্যক্তিগত ভিডিফোন থাকত তা হলে সে এখন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারত। এখন করতে হলে সেটা করতে হবে। অফিসের মাধ্যমে তার যন্ত্রণা অনেক। হঠাৎ করে সে তার অনাথাশ্রমের বন্ধুদের অভাব অনুভব করতে থাকে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে তাদের সাথে দেখা করতে যাবে।
সুহান দুদিন পর আবার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করল। ঘণ্টা দুয়েক আগে রিয়ানা মস্তিষ্কের ভেতরে খবর দিয়ে গেছে ডাক্তারকে কী বলাতে হবে। অতলান্ত স্ট্রিটে একটা সুপার মার্কেটে সি ফুডের দোকানের সামনে রিহা আর কিলি নামে দুজন থাকবে। সুহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, দুজন মানুষকে ধরিয়ে দেব?
হ্যাঁ। রিয়ানা বলেছিল, আমরা যেভাবে সম্ভব তোমাকে সন্দেহের বাইরে রাখতে চাই। দরকার হলে আমাদের একজন মানুষকে ধরিয়ে দিয়েও।
সুহান জিজ্ঞেস করল, যাদেরকে ধরিয়ে দিচ্ছি তারা জানে?
হ্যাঁ তারা স্বেচ্ছায় ধরা দিতে রাজি হয়েছে।
তাদের কী করবে?
রিয়ানা বলেছিল, আমরা জানি না। যদি ভাগ্য ভালো থাকে বেঁচে থাকবে।
সুহান আর কথা বাড়ায় নি, সে বিশাল একটা পরিকল্পনার অংশ। তাকে যেটা করতে হবে সে সেটা করবে, এ ছাড়া উপায় কী?!!
ভিডিফোনে যোগাযোগ করতেই ডাক্তার উদগ্রীব গলায় বলল, কী হয়েছে সুহান?
আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না। আমি কি একটু ঘুমের ওষুধ খেতে পারি?
তার আগে শুনি কেন ঘুমাতে পারছ না। কী হয়েছে?
একজন মানুষ ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।
কী নিয়ে কথা বলছে?
দুজন মানুষের সাথে দেখা করা নিয়ে মানুষটা খুব দুশ্চিন্তা করছে।
মানুষটা কে?
সুহান অধৈর্য গলায় বলল, আমি কেমন করে বলব? আমার মস্তিষ্কে কি আর বাইরের মানুষ কথা বলতে পারে? নিশ্চয়ই আমার অবচেতন মন আমার সাথে কথা বলছে।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি বলল, তা ঠিক। তা ঠিক। নিশ্চয়ই তোমার অবচেতন মন।
আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিন। খেয়ে অবচেতন এবং চেতন মন দুটোকেই কাবু করে ঘুমিয়ে থাকি।
দেব। নিশ্চয়ই দেব। ডাক্তার বলল, তার আগে শুনি তোমার অবচেতন মন কার সাথে দেখা করা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে।
দুজন মানুষ। একজনের নাম রিহা আরেকজন কিলি।
তুমি কি বিহা আর কিলি সম্পর্কে আর কিছু জান?
হ্যাঁ। অনেক কিছু জানি—কিন্তু তার কি কোনো গুরুত্ব আছে? পুরোটা নিশ্চয়ই আমার কল্পনা।
ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু তবু ডাক্তার হিসেবে আমার শুনে রাখা উচিত।
সুহান গলার স্বরে এক ধরনের বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, রিহা আর কিলি নাকি অতলান্ত স্ট্রিটে একটা সুপার মার্কেটে সি ফুডের দোকানে যাচ্ছে।
ও আচ্ছা।
আমি এখন কী করব ডাক্তার।
তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার জন্য আমি যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি তার দুটি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।
সুহান দুটি ঘুমের ওষুধ টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর জন্য তার কখনোই ঘুমের ওষুধের দরকার হয় না।
সুহান খুব ধীরে ধীরে তার মাথার ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। যে মানুষগুলোর সাথে তাকে সমন্বয় করেছে সে একজন একজন করে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে শিখেছে। একসাথে তাদের সবার সাথে কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে পারে, জটিল কোনো সমস্যার সমাধান বের করতে পারে। তার জন্য সবচেয়ে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে নোর চোখ দিয়ে দেখা। ঠিক কী কারণ জানা নেই, সবার সাথে সে সমান দক্ষতা দিয়ে কাজ করতে পারে না। খিরু নামের তরুটার সাথে তার সবচেয়ে ভালো সমন্বয় হল খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করলে সে থিরুর চোখে দেখতে পায়। প্রথমবার যখন দেখতে পেল তখন থিরু একটা মনিটরের সামনে বসে কাজ করছে। সুহান এক মুহূর্তের জন্য আবছাভাবে মনিটরটা দেখতে পেল এবং হঠাৎ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সুহান ফিসফিস করে বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি থিরু।।
থি বলল, চমৎকার। তুমি আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য—-তোমাকে অন্যের চোখে দেখা শিখতে হবে। জুনোর মস্তিষ্কে ভাবতে হবে।
আমি চেষ্টা করব।
যখন তুমি পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে যেতে পারবে তখন বুঝতে পারবে যে তুমি সমন্বিত মানুষ হতে পেরেছ। সেজনা তোমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে।
সুহান তাই চেষ্টা করে যেতে থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা তাকে এখন অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। রিহা আর কিলিকে ধরিয়ে দেবার পর তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সে কবে ভার কাজে ফিরে যেতে পারবে জানতে চেয়েছে, নিরাপত্তা দৃপ্তর থেকে জানিয়েছে খুব শিগগিরই।
সুহান সেজন্য অপেক্ষা করে আছে। তাকে যেদিন কাজে যেতে দেবে সেদিনই তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে শেষবার হানা দেবার কথা। সুহান তার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সম্ভবত তাকেই হানা দিতে হবে—তথ্যকেন্দ্রটা তার চাইতে ভালো করে আর কেউ জানে না। অন্য সবার সাথে সমন্বিত হয়ে থাকবে সে, তাকে কী করতে হবে সবাই বলে দেবে। তথ্যকেন্দ্রের শেষ কোডটা ভেঙে তাকে বিজ্ঞানীদের সেই রিপোর্ট নেটওয়ার্কে দিয়ে দিতে হবে। মুহূর্তের মাঝে পৃথিবীর সবাই জেনে যাবে ক্যাটাগরি-বি. নামের ধারণাটা আসলে একটা বিশাল প্রতারণা, একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র।