সুহান তার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে রিয়ানাকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা রিয়ানা আমি কেমন করে তোমার সাথে কথা বলছি? স্বপ্নে কেমন করে আমার তোমার সাথে পরিচয় হল?
বলব, তোমাকে আমি সব বলব। কিন্তু তার আগে তুমি একটু সহজ ভঙ্গিতে বস্। কিছু একটা খাবার অর্ডার দাও। খাবার খেতে খেতে একা একা মানুষ যা করে তাই কর, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কাগজে কিছু আঁকাআঁকি কর। আঁকাআঁকি করতে করতে সেখানে লিখবে ৩৭ নেপচুন এভিনিউ। তারপর এই কাগজটা এখানে ফেলে যাবে।
কেন রিয়ানা?
নিরাপত্তা বাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। আমরা ৩৭ নেপচুন এভিনিউতে কিছু গোপন লিফলেট, বেআইনি কাগজ ফেলে রাখব। তারা সেগুলো উদ্ধার করবে। তোমাকে তখন আরো বেশি বিশ্বাস করবে।
সুহান চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দূরে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না রিয়ানা। আমাকে কে বিশ্বাস করবে? কেন বিশ্বাস করবে?
বলছি। রিয়ানা নরম গলায় বলল, সবকিছু বলছি। তার আগে তোমার অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর দিই। স্বপ্নে তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিল মনে আছে? আমি বলেছিলাম প্রশ্নটা তুমি এখন করো না, পরে করো। মনে আছে?
সুহান অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! আমি স্বপ্নে কী প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম তুমি সেটা জান?
হ্যাঁ। জানি। কারণ সেই স্বপ্নটা আমি তৈরি করেছিলাম।
কেমন করে তৈরি করেছিলে?
তার আগে তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর জানতে চাও না?
হ্যাঁ জানতে চাই।
রিয়ানা নরম গলায় বলল, তুমি প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলে আমি কি সাধারণ মানুষ নাকি ক্যাটাগরি-বি. তাই না?
হ্যাঁ।
তোমার সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য তোমাকে আমরা এখানে এনেছি। রিয়ান নিচু গলায় বলল, আমরা তোমার মতো ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। আমরা তোমার মতোই সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছি।
সুহান বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম।
মানুষকে ক্যাটাগরি-বি. হিসেবে ভাগ করে দিয়ে তাদেরকে উপেক্ষা করার ব্যাপারটা আসলে একটা খুব বড় হীন ষড়যন্ত্র। ক্যাটাগরি-বি. মানুষ কোনোভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ নয়। মানুষের মাঝে যে স্বাভাবিক বৈচিত্র্য আছে এটা তার ভেতরের একটা অংশ।
আমিও সেটা বিশ্বাস করি।
আমরা সবাই সেটা বিশ্বাস করি। রিয়ানা বলল, সেই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি আছে। বিজ্ঞানীদের একটা টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটা গবেষণা করে একটা রিপোর্ট দিতে। তারা অত্যন্ত সুন্দর একটা রিপোর্ট দিয়েছিলেন।
সুহান জানতে চাইল, সেই রিপোর্টটা কোথায়?
তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে।
সুহানকে ঘিরে অনেক নিরাপত্তাকর্মী বসে আছে, নিশ্চয়ই তাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে, তাই অনেক কষ্ট করে সে তার মুখের বিশ্বয়টুকু গোপন করার চেষ্টা করল। ফিসফিস করে বলল, তোমরা সেই রিপোর্টটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছ?
হ্যাঁ।
কিছুদিন আগে একজন মানুষকে তথ্যকেন্দ্রে খুন করা হয়েছিল, আমি তখন সেখানে ছিলাম, সে কি তোমাদের একজন?
হ্যাঁ, সে আমাদের একজন। সে আমাদের তোমার কথা বলেছে।
সুহান অনেক কষ্ট করে মুখের বিময়টুকু গোপন করে রেখে বলল, সে কেমন করে বলল? আমি নিজের চোখে দেখেছি তাকে রিগা গুলি করে মেরেছে—সে বের হতে পারে নি।
সে জানত সে কখনো বের হতে পারবে না। সে জানত তাকে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু তবুও তোমার সাথে তার কী কথা হয়েছে আমরা সেটাও জানি।
কেমন করে জান?
আমি এখন তোমার সাথে যেভাবে কথা বলছি, ঠিক সেভাবে তার সাথেও কথা বলছিলাম। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কথা বলছিলাম।
সুহান অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। রিয়ানা বলল, আমরা তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। নিরাপত্তার অনেকগুলো স্তর পার হয়ে গেছি। আর একবার তথ্যকেন্দ্রের ভেতরে যেতে পারলে আমরা বিজ্ঞানীদের দেওয়া সত্যিকার রিপোর্টটা বের করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু ঠিক তখন হঠাৎ করে তুমি এসে হাজির হয়েছ। আমাদের সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেছে।
কেন? সুহান অবাক হয়ে বলল, আমি কী করেছি?
আমাদের অসম্ভব বড় একটা সৌভাগ্য যে তুমি এরকম বুদ্ধিমান একটা ছেলে, জেনে জেনে এখন পর্যন্ত কোথাও তুমি একটা ছোট ভুলও কর নি। কিন্তু তোমার কারণে আমরা খুব বিপদের ভেতরে আছি। যে কোনো মুহূর্তে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।
আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না।
কুলছি তোমাকে। আমাদের হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই, আমরা ঝুঁকি নেব না–আমরা কিছুক্ষণের মাঝে উঠে যাব। তুমি আরো কিছু সময় বসে থেকে তারপর ফিরে যেও।
ঠিক আছে। সুহান বলল, এখন বলো আমি কীভাবে তোমাদের বিপদের মাঝে ফেলেছি।
রিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পৃথিবীর ক্যাটাগরি-বি. মানুষরা যখন বুঝতে পারুল তাদের বিরুদ্ধে খুব একটা অন্যায় ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তখন তাদের একটা ছোট দল অত্যন্ত বিচিত্র উপায়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে।
সেটা কী রকম?
আমরা প্রত্যেকেই আলাদা। প্রত্যেকটা মানুষের মস্তিষ্ক আলাদা, তাদের ভাবনা-চিন্তা আলাদা। মাঝে মাঝে অনেকে একসাথে বসে চিন্তা-ভাবনা করে পরামর্শ করে কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে করে। আমাদের ভেতরে একজন বড় বিজ্ঞানী আছেন তিনি ঠিক করলেন আমাদের অনেকের মস্তিষ্ক একসাথে জুড়ে দেবেন। তখন আমরা আর আলাদা আলাদা মানুষ থাকব না, আমরা সবাই মিলে একজন মানুষ হয়ে যাব। আমাদের সবার মস্তিষ্ক মিলে একটা মস্তিষ্ক হয়ে যাবে। তাতে কী লাভ হবে বুঝতে পেরেছ?