একসময় ভেতরে বাতাসের চাপ গ্রহণযোগ্য হয়ে এল এবং তখন ঘড়ঘড় শব্দ করে ভেতরের দরজা খুলে গেল। রিশি এবং টিৰিনা হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ধরে রাখে। দরজার অনাপাশে উসকোখুসকো চুলের মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটিও দুই হাতে একটি টাইটেনিয়ামের রড ধরে রেখেছে, তার চোখ দুটো অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো জ্বলজ্বল করছে। রিশি একটু ইতস্তুত করে বলল, আমরা তোমার বিপদ সংকেত পেয়ে তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি।
মানুষটা হাতের টাইটেনিয়ামের রডটি ধরে রেখে সতর্ক গলায় বলল, এল। ভেতরে এস। মানুষটির গলার স্বর শুষ্ক এবং কঠিন।
রিশি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমার নাম রিশি। আর আমার সাথে আছে টিরিনা।
মানুষটি বলল, আমার নাম মান। তোমাকে অভিবাদন ধ্রুমান।
তোমাদেরকেও অভিবাদন। আমাকে উদ্ধার করতে আসার জন্য তোমাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা।
রিশি একটু অবাক হয়ে দেখল, মানুষটি মুখে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে কিন্তু হাতে শক্ত করে টাইটেনিয়ামের বন্ডটি ধরে রেখেছে। মানুষটি বলল, তোমরা ইচ্ছে করলে এই পোশাক খুলে ফেলতে পার। আমার এই ঘর দেখে খুব বিবর্ণ মনে হলেও এটি পুরোপুরি নিরাপদ।
রিশি এবং টিরিনাও সেটা লক্ষ করেছে। মহাকাশচারীর পোশাকের নিরাপত্তাসূচক আলোটি অনেকক্ষণ থেকেই সবুজ হয়ে আছে। টিরিনা তার পোশাকটি খুলতে গিয়ে থেমে গেল, জিজ্ঞেস করল, মান! তুমি হাতে এই টাইটেনিয়ামের রডটি অস্ত্রের মতো করে ধরে রেখেছ কেন?
মান নিজের হাতের দিকে তাকাল এবং মনে হল ব্যাপারটি প্রথমবার লক্ষ করল। সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাতের টাইটেনিয়ামের রঙটি একটা শেলফে রেখে বলল, তোমরা কিছু মনে করো না। আমি বিশ বছর একা একা এই হটাতে আছি। আমার আচার-ব্যবহারে নানা ধরনের অসঙ্গতির জন্ম হয়েছে—তোমরা কিছু মনে করো না।
টিরিনা হেলমেটটা খুলে হাতে নিয়ে বলল, না আমরা কিছু মনে করব না। একা একা থাকার জন্য বিশ বছর খুব দীর্ঘ সময়।
রিশি বলল, কোনো রকম খাওয়া, পানীয়, জ্বালানি ছাড়া তুমি কেমন করে এতদিন এখানে বেঁচে আছ?
কষ্ট করে।
কিন্তু শুধু কষ্ট করে তো এটি সম্ভব নয়।
দ্রুমান একটু হাসার চেষ্টা করল, সব মানুষকেই হাসলে সুন্দর দেখায় কিন্তু যে কোনো কারণেই হাসিমুখে দ্রুমানকে মুহূর্তের জন্য কেমন জানি ভয়ংকর দেখাল। সে তার এই ভয়ংকর হাসিটি বিস্তৃত করে বলল, আমাকে বেঁচে থাকার জন্য অনেক ফন্দিফিকির করতে হয়েছে।
রিশি তার পোশাক খুলতে খুলতে বলল, হ্যাঁ, ফিরে যাবার আগে আমরা তোমার ফন্দিফিকির দেখতে চাই।
দ্রুমান আবার ভয়ংকর হাসিটি হেসে বলল, দেখবে। নিশ্চয়ই দেখবে।
টিরিনা বলল, তোমার এখানে দেখছি নিয়মিত ইলেকট্রিক সাপ্লাই আছে। তার মানে কোনো এক ধরনের জেনারেটর আছে।
দ্রুমান মাথা নাড়ল, হঁ আছে।
সেটা তুমি কী দিয়ে চালাও? আমাদের মহাকাশযানের তথ্যকেন্দ্রে দেখেছি এই গ্ৰহটাতে বাইরের কোনো শক্তি নেই। খুব বাজে গ্রহ।
দ্রুমান বিচিত্র একটি দৃষ্টিতে টিরিনার দিকে তাকাল। বলল, আমার কাছে এখন এটাকে আর বাজে গ্রহ মনে হয় না। মানুষ যখন দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভোগে তখন সেই রোগটার জন্য মায়া পড়ে যায়। আর এটা একটা আস্ত গ্রহ।
টিরিনা চোখ কপালে তুলে বলল, তার মানে এই হটার জন্যও তোমার একটু মায়া পড়ে গেছে।
দ্রুমান একটা নিশ্বাস ফেলল। বলল, গ্রহটার থেকে বেশি মায়া পড়েছে আমার এই জায়গাটার জন্য। এর প্রত্যেকটা পাথরের টুকরো আমার নিজের হাতে বানো। বেঁচে থাকার জন্য কী না করেছি। শেষ পর্যন্ত যখন ইলেকট্রিসিটির ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারলাম তখন মনে হল হয়তো বেঁচে যাব।
রিশি বলল, তোমাকে অভিনন্দন দ্রুমান—এরকম একটা পরিবেশে বেঁচে থাকা প্রায় অলৌকিক একটা ব্যাপার।
দ্রুমান মাথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, আসলেই এটা অলৌকিক।
টিরিনা ঘরটির ভেতরে ঘুরে দেখে। দেয়ালে আলোর সুইচ ছিল। প্রায় অন্যমনস্কভাবে সে একটা সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল, সাথে সাথে পুরো ঘরটি উজ্জ্বল আলোতে ভরে যায়। দ্রুমান হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, না।
না? টিরিনা অবাক হয়ে বলল, কী না?
দ্রুমান কঠিন গলায় প্রায় ছুটে এসে আলোটা নিভিয়ে দিতেই পুরো ঘরটি আবার আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেল। দ্রুমান কঠিন গলায় বলল, তুমি আলো জ্বালবে না। শক্তির অপচয় করবে না।
টিরিনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে তোমাকে আমরা নিয়ে যাব। তোমাকে এখানে থাকতে হবে না। এতদিন যেভাবে শক্তি বাচিয়েছ তোমাকে আর সেভাবে শক্তি বাঁচাতে হবে না!
হ্যাঁ। নিশি বলল, তুমি দুই-তিন বছরে যে পরিমাণ শক্তি খরচ কর আমাদের স্কাউটশিপে তার থেকে বেশি শক্তি জমা আছে?
থাকুক। তার মানে এই নয় যে তুমি শক্তির অপচয় করবে।
রিশি আর তর্ক করল না। বলল, ঠিক আছে। এটা তোমার জায়গা, তুমি যেটা বলবে সেটাই নিয়ম।
হ্যাঁ। দ্রুমান মাথা নেড়ে বলল, সেটা সব সময় মনে রাখবে। এটা আমার জায়গা। আমার অনুমতি ছাড়া এখানে তোমরা কিছু স্পর্শ করবে না। বুঝেছ?
রিশি মাথা নাড়ল। বলল, বুঝেছি!
মানুষটি একা একা থেকে পুরোপুরি অসামাজিক হয়ে গেছে, স্বাভাবিক ভদ্রতার বিষয়গুলোও পুরোপুরি ভুলে গেছে।
শুধু যে স্বাভাবিক ভদ্রতার বিষয়গুলো ভুলে গেছে তাই নয় রিশি আর টিরিনা একটু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, মানুষটির আরেকটি বিচিত্র অভ্যাসের জন্ম হয়েছে। সে সব সময় নিজের সাথে কথা বলে। বেশিরভাগ সময় বিড়বিড় করে কিন্তু প্রায় সময়েই বেশ জোরে জোরে। তার এই ঘর, থাকার জায়গা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শক্তি, শক্তির অপচয়, খাবার আর পানীয়ের সঞ্চয় এইসব বিষয় নিয়ে সব সময় নিজের সাথে পরামর্শ করছে। মানুষটি আবার দুর্ব্যবহার করবে এ ধরনের একটা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও টিরিনা জিজ্ঞেস করল, দ্রুমান, তুমি নিশ্চয়ই দীর্ঘদিন সত্যিকারের খাবার খাও নি?