ঠিক তখন ক্যাফেটার দরজা খুলে গেল, সুহান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল, ভেতর থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে এসেছে, মেয়েটি তার মাথার অবাধ্য চুলগুলোকে একটা লাল স্কার্ফ দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মেয়েটার গায়ের রঙ রোদে পোড়া তামাটে, চোখগুলো বুদ্ধিদীপ্ত এবং উজ্জ্বল। মেয়েটা ঠোট চেপে মুখ বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু সুহান নিশ্চিতভাবে জানে যখন এই মেয়েটা হাসবে তখন দেখা যাবে তার পঁাতগুলো মুক্তার মতো। ঝকঝকে। সুহান চিৎকার করে ডাকতে যাচ্ছিল বিয়ানা, তুমি? কিন্তু ঠিক তখন কেউ একজন তার মাথার ভেতরে ফিসফিস করে বলল, খবরদার সুহান, তুমি আমাকে ডেকো। না। আমাকে চেনার ভান করো না। কিছুতেই না।
কেন নয়? সুহান অবাক হয়ে দেখল একটা কথা উচ্চারণ না করে সে রিয়ানার সাথে কথা বলছে।
তোমার আশপাশে নিরাপত্তা বাহিনীর লোক কিলবিল করছে।
সত্যি?
সুহান দেখল তার পাশ দিয়ে রিয়া অপরিচিতের মতো হেঁটে চলে গেল। যাবার সময় তার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে বলল, তুমি জান কোথায় যেতে হবে?
হ্যাঁ জানি।
এস। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
বেশ।
আমার পিছু পিছু নয় একটু সময় নাও। তারপর এস।
ঠিক আছে রিয়ানা। সুহান অবাক হয়ে দেখল কী অবলীলায় সে একটা শব্দ মুখে উচ্চারণ না করে শুধু চিন্তা করে কথা বলে ফেলছে। কেমন করে সে পারছে।
সুহান মাথা ঘুরিয়ে না তাকিয়েও বুঝতে পারল তার আশপাশে কিছু মানুষ তাকে লক্ষ করছে। নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষ। তাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে, সে কী করে সেটা লক্ষ করছে। কিশলয় ক্যাফের সামনে সে থমকে দঁাড়িয়েছে তাই এর ভেতরেই তার ঢোকা উচিত। সুহান ক্যাফেটাতে ঢোকে, ভেতরে বেশ ভিড়। খালি টেবিল নেই। দূরে একটা টেবিল খালি হয়েছে, সে সেখানে গিয়ে বসে। এখানে খানিকক্ষণ সময় কাটাবে সে, স্নায়ুকে শীতল করার জন্য একটা পানীয় খাবে তারপর হেঁটে হেঁটে যাবে ক্যাফে অর্কিডে। ঠিক যেরকম সে স্বপ্নে দেখেছিল।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ সুহানকে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমার টেবিলে বসতে পারি? ক্যাফেতে খালি টেবিল নেই তাই তার এখানে বসতে চাইছে। সূহান মাথা নাড়ল। মানুষটার ধৈর্য নেই, সে বসেই উচৈঃস্বরে ওয়েট্রেসকে ডাকতে শুরু করে। ওয়েট্রেস এলে দুজনেই পানীয়ের অর্ডার দিল, একজন স্নায়ু শীতল অন্যজন স্নায়ু উত্তেজক পানীয়।
সুহান স্বায়ু শীতল করার পানীয়টা চুমুক দিয়ে চোখের কোনা দিয়ে মানুষটাকে লক্ষ করে। এই দুপুর বেলা সে যে পানীয়টা খাচ্ছে সেটা দুপুরে খাবার কথা নয়। মানুষটা সম্ভবত উত্তেজক পানীয়তে নেশাগ্রস্ত। সুহান একটু শঙ্কিত হয়ে বসে থাকে, একই টেবিলে বসার কারণে মানুষটা যদি হঠাৎ করে তার সাথে কথা বলতে রু করে সেটা একটা অহেতুক বিড়ম্বনা হবে। তার এখন কথা বলার ইচ্ছে করছে না, একটু আগে যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা সে এখনো পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারে নি। নেশাগ্রস্ত মানুষটা অবিশ্যি কথা বলার উৎসাহ দেখাল না। গভীর মনোযোগ দিয়ে তার পানীয়তে চুমুক দিতে থাকল।
কিশলয় ক্যাফে থেকে বের হয়ে সুহান ডানদিকে হাঁটতে থাকে। প্রথমে একটা ফুলের দোকান, তার পাশে ক্রিস্টালের দোকান। রিয়ানা চাইছে একটু সময় নিতে, তাই সে ক্রিস্টালের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টালগুলো দেখতে থাকে। খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল বলে সে লক্ষ করল না, কিশলয় ক্যাফে থেকে উত্তেজক পানীয় নেশাসক্ত মধ্যবয়স্ক মানুষটাকে নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটা ভয়ার্ত গলায় বলছে, কী করেছি আমি? কী করেছি? উত্তেজক পানীয় খাবার জন্য ঘটনাক্রমে সুহানের টেবিলটা বেছে নিয়ে সে যে নিজের ওপর কী ভয়ানক দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
সুহান ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে যায়। ডানদিকে হেঁটে সে পোশাকের দোকানটা পার হল। তার পাশে ভাস্কর্যের দোকান—তার পাশে ক্যাফে অর্কিড। ইতস্তত তরুণ-তরুণীরা বসে আছে, নিচু গলায় কথা বলছে, হাসছে। সুহান সেদিকে হেঁটে যায়, তাকে কোথায় বসতে হবে সে জানে, তার টেবিলটা খালি।
সুহান টেবিলটাতে বসার সময় শুনতে পেল রিয়ানা তার মস্তিষ্কের ভেতর বলছে, আমি তোমার কাছাকাছি আছি, কিন্তু তুমি কোনোভাবেই আমাকে চেনার ভান করবে না।
করব না রিয়ানা।
চমৎকার।
তোমার সাথে সাথে এখানে অসংখ্য নিরাপত্তাকর্মী চলে এসেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ। তোমার ডান দিকে যে মোটা মানুষটা বসেছে সে একজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। পিছনে যে দুজন বসেছে তারাও। ভাস্কর্যের দোকানের সামনে যে মহিলা দুজন দাঁড়িয়েছে তারাও। এইমাত্র রাস্তার পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, সেটাও নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি। কাজেই সাবধান।
সুহান একটা শব্দও উচ্চারণ না করে বলল, রিয়ানা আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা ঘটছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা সত্যি।
এটা সত্যি। আমি তোমার দুই টেবিল সামনে বসেছি। আমার সাথে আরো দুজন আছে। আমরাও একটা উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে তর্ক করছি। পুরোটা একটা অভিনয়। আমরা এসেছি তোমার জন্য। তোমার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করার জন্য।
সুহান চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, সত্যি সত্যি তার টেবিল থেকে দুই টেবিল সামনে রিয়ানা বসে আছে, তার দুই পাশে দুজন সুদর্শন তরুণ।