হ্যাঁ।
এই যে খালি টেবিলটা দেখছ, তুমি এখানে বস সুহান।
সুহান খালি টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল। রিয়ানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি? তুমি বসবে না?
হ্যাঁ বসব। কিন্তু তোমার সাথে না। অন্যখানে।
কেন রিয়ানা? আমার সাথে নয়, কেন?
কারণ আছে সুহান।
কী কারণ?
সেই কারণটি আরেকদিন বলব।
সুহান ব্যাকুল হয়ে বলল, আরেকদিন কেন? আজকে কেন নয়?
ঠিক তখন সুহানের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল, তার কাছাকাছি একন ডাক্তার এবং দুজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার তার ওপর ঝুঁকে বলল, তুমি স্বপ্ন দেখছিলে?
হ্যাঁ দেখছিলাম। তুমি কেমন করে জান?
তোমার আর.ই.এম. হচ্ছিল। মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন তার আর.ই.এম. হয়।
ও।
ডাক্তার আরো একটু ঝুঁকে পড়ল, বলল, তুমি কী স্বপ্ন দেখছিলে সুহান?
সুহান ডাক্তারের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে এই মানুষটার কৌতূহলটাকে তার অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হতে থাকে। তার ভেতরে বিচিত্র একটা ক্রোধ জেগে উঠতে থাকে কিন্তু তাকে তার ক্রোধটাকে গোপন রাখতে হবে। ভেতরকার সত্যি কথাটাও তার গোপন রাখতে হবে। ডাক্তার তার কথা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিছু একটা তাকে বলতে হবে। সুহান বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি একটা সার্কাস।
সার্কাস?
হ্যাঁ। সার্কাস।
কী হচ্ছে সেই সার্কাসে?
সার্কাসে একটা মানুষ অনেকগুলো সিংহকে নিয়ে খেলছে।
স্বপ্নে কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
হ্যাঁ বলেছে।
কে বলেছে? কী বলেছে? ডাক্তারের চোখ হঠাৎ চকচক করে ওঠে।
সিংহগুলো। সিংহগুলো আমাকে বলেছে।
ডাক্তারের চোখ-মুখের উৎসাহ একটু থিতিয়ে যায়, ইতস্তত করে বলে, সিংহ কি কখনো কথা বলে?
সুহান হাসার ভঙ্গি করল, বলল, স্বপ্নের ব্যাপার! স্বপ্নের কি কোনো মাথামুণ্ডু আছে নাকি? স্বপ্নে সিহুঁ কথা বলে। হাতি ওড়ে।
তা ঠিক।
সুহান বলল, সিংহগুলো কী বলছে শুনতে চাও?
ডাক্তারের উৎসাহ এতক্ষণে অনেক কমে এসেছে, তবুও জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে?
বলেছে, আমরা সকালে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের কলজে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। দুপুর বেলা খাই তাদের কিডনি।
ডাক্তার এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান বলল, সিংহগুলো ডিনারের সময় কী খেতে চায় জান?
ডাক্তার মাথা নাড়ল, বলল, নাহ! শুনে কাজ নেই। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা কর।
সুহান আবার চোখ বুজল। তার মাথার মাঝে আবার অসংখ্য মানুষের কথার শব্দ ভেসে আসে। সে জোর করে তার মাথা থেকে কথাগুলো সরিয়ে দেয়। হঠাৎ করে তখন তার রিয়ানার কথা মনে হল। কী অসম্ভব বাস্তব এই স্বপ্নটুকু। এখনো মনে হচ্ছে স্বপ্ন নয় সত্যি।
কী বিচিত্র এই স্বপ্নটুকু। কী আশ্চর্য!
সুহান রিয়ানার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গেল।
০৬.
সুহানকে তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল। কিন্তু তাকে তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে দিল না–তাকে শহরের ভেতরে একটা ছোট অ্যাপার্টমেনে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। সে একজন তুচ্ছ ক্যাটাগরি-বি. মানুষ, তার জন্য এত আয়োজনের কারণটুকু সে জানতে চেয়েছিল, সঠিক উত্তরটুকু কেউ দিতে পারল না। ভাসা ভাসা ভাবে শুনতে পেল যে তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরীর এই দায়িত্বটার একটা অন্য ধরনের গুরুত্ব রয়েছে—তাকে সঠিক নিরাপত্তা দেওয়া এখন সরকারের দায়িত্বের মাঝে এসে পড়েছে।
সুহান খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাল না। সে এখনো দূর্বল। মাথার ভেতরে সব সময়ে মানুষের কোলাহল, তার কী হয়েছে সে এখনো বুঝতে পারে নি। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে মানুষের কথা শুনতে পায় তা নয়, সে আবিষ্কার করেছে সে অন্যরকম একটা মানুষ হয়ে গেছে। ধীরলয়ের সঙ্গীত সে একেবারেই পছন্দ করত না, এখন মাঝে মাঝে সেটা শুনতে তার বেশ ভালো লাগে। হঠাৎ হঠাৎ তার মাঝে খুব বড় পরিবর্তন হয়, সে কিছুক্ষণের জন্য একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়। একদিন সকালে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল—সে মধ্যযুগের সকল চিত্রশিল্পীর নাম জানে। কিছুক্ষণ পর সে নামগুলো ভুলে গেল। মাঝখানে একবার তার মনে হল সে মানুষের রোগের চিকিৎসা করতে পারবে—সব রোগের চিকিৎসা সবকিছুই সে জানে। এই অনুভূতিগুলো তার আসে এবং যায় কিন্তু একটা ব্যাপার মোটামূটি পাকাপাকিভাবে ঘটে গেছে। সেটা হচ্ছে তার স্মৃতিশক্তি সেটা অসম্ভব বেড়ে গেছে, কোনো একটা কিছু একবার দেখলেই সে খুঁটিনাটি সবকিছু মনে রাখতে পারে। এটা কেমন করে ঘটেছে সে কিছুতেই ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না।
নিজের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে আসার একদিন পর সে ঘর থেকে ঘটতে বের হল। সে এখনো দুর্বল, কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে তখন ফুটপাতে একটা ছোট্ট বেঞ্চে বসে সে বিশ্রাম নিতে থাকে। অন্যমনস্কভাবে সামনে তাকিয়ে সে হঠাৎ চমকে ওঠে, এই জায়গাটা সে আগে দেখেছে—বাস্তবে নয় স্বপ্নে, এই রাস্তাটার নাম অতলান্তে সড়ক, ছোট কিন্তু ব্যস্ত একটা রাস্তা আজকে নিজের অজান্তেই সে এদিকে হেঁটে চলে এসেছে। একদিন সে এই রাস্তাটাকেই স্বপ্ন দেখেছিল। সে ডানে এবং বামে তাকাল এবং অবাক হয়ে দেখল সত্যিই সেখানে কিশলয় ক্যাফে নামে একটা ক্যাফে রয়েছে।
মুহূর্তের মাঝে সুহান তার ক্লান্তি ভুলে উঠে দাড়াল। সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্যাফেটার দিকে হাঁটতে থাকে। ক্যাফেটার সামনে গিয়ে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কী আশ্চর্য! সে সত্যি সত্যি স্বপ্নে এই ক্যাফেটা দেখেছিল।