মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, মনে হল তারা এটা শুনে খুব আশ্বস্ত বোধ করছে। কিন্তু কথায় সেটা প্রকাশ করল না, খুব দুশ্চিন্তার ভঙ্গি করে একজন বলল, মাখার ভেতরে কথা বলছে? কী আশ্চর্য!
আরেকজ্জন একটু এগিয়ে এসে বলল, কী নিয়ে কথা বলে?
সুহান মানুষটার মুখের দিকে তাকাল, কেউ একজন তার মাথায় তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ভয়ংকর একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাকে খুব সাবধান থাকতে হবে। সে সাবধানে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হচ্ছে ততক্ষণ সে কিছুই বলবে না। কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে তা না হলে তাকে সন্দেহ করবে। কথা বলতে হবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা কথা বলা সোজা, সেটা হতে হয় সত্যের খুব কাছাকাছি। কাজেই সে সত্যের কাছাকাছি মিথ্যা কথা বলবে। মানুষটা আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, কী নিয়ে কথা বলে তোমার সাথে?
সেটা বুঝতে পারি না। সুহান মাথা নাড়ল, বলল, অবিশ্যি বোঝার চেষ্টাও করি না। এমন তো না যে বাইরে থেকে কেউ আমার সাথে কথা বলছে–তাই কথাটা বোঝার দরকার আছে। আমি যে কথাগুলো শুনি সেটা নিশ্চয়ই আমার নিজের মস্তিষ্কের একটা প্রতিক্লিয়া, আমার অবচেতন মনের কথা। এটা শুনেই কী আর না শুনেই কী?
ডাক্তারের পোশাক পরা মানুষটাকে এবারে খানিকটা বিপন্ন মনে হল, আমতা-আমতা করে বলল, হলে তুমি কথাগুলো বোঝার চেষ্টা কর না?
না! সুহান সরল মুখ করে বলল, কেন করব? আমি তো আর পাগল না যে নিজের সাথে নিজে কথা বলব। তাই চেষ্টা করি না শুনতে।
কিন্তু—কিন্তু–মানুষটাকে হঠাৎ কেমন যেন বিপদগ্রস্ত মনে হয়, কিন্তু সেই কথাটা যদি ডাক্তার না জানে সে তা হলে তোমার চিকিৎসা করবে কেমন করে? মানুষটা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না ডাক্তার?
ডাক্তার অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
তুমি তা হলে চেষ্টা কর শুনতে। তোমার মস্তিষ্কে কী কথা হচ্ছে সেটা শুনে ডাক্তারকে জানাবে। সাথে সাথে জানাবে। একেবারেই দেরি করবে না।
সুহান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে? মানুষটার কথা বলার ভঙ্গি, আচার-আচরণটা অত্যন্ত সন্দেহজনক। এদের উদ্দেশ্য কী পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কিছুতেই তাদেরকে কোনো কিছু জানানো যাবে না। কোনোভাবেই না। সুহান ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হয়েছে? আমি কেন এরকম মানুষের কথা শুনতে পাই?
ডাক্তার মানুষটা সুহানের চোখ এড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল একটা বিষয়। বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরেও মানুষ মস্তিষ্ককে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। তোমার সেই মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছ, সেখানে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সেখানে একটা চাপের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই চাপটা কমানোর জন্য অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে, অস্ত্রোপচারের সময় মস্তিষ্কের কোনো কোনো অংশে কোনো ধরনের পরিবর্তন হতে পারে, তার জন্য সাময়িক কোনো প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
তা হলে আমি যেটা শুনছি সেটা কোনো সত্যি ব্যাপার নয়—সেটা পুরোপুরি আমার কল্পনা?
না মানে ইয়ে. ডাক্তারকে কেমন যেন বিপন্ন দেখায়। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল একটা বিষয় সেটা কীভাবে কাজ করে আমরা এখনো ঠিক জানি না। মস্তিষ্ক নিয়ে অনেক বিচিত্র ব্যাপার ঘটে।
সুহান ব্যাপারটি নিয়ে আর কিছু বলল না। সে বুঝে গেছে তার প্রশ্নের সত্যিকার উত্তর আর পাবে না। সে তাই অন্য প্রসঙ্গে এল, বলল, আমাকে কবে যেতে দেবে?
আরো দুই-তিন দিন পর্যবেক্ষণে রেখে আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব। আমাকে কি এই কয়েকদিন সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে? না, সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে না। তবে তোমার মাথায় কিছু সেন্সর লাগানো আছে, শুয়ে না থাকলে আমরা সেই সেন্সরগুলো লক্ষ করতে পারব না। কাজেই আপাতত তোমার জন্য শুয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সুহানের কেবিন থেকে সবাই বের হয়ে গেলে সুহান তার চোখ বন্ধ করল এবং হঠাৎ করে মনে হল কেউ একজন তাকে বলল, চমৎকার! ভারি চমৎকার।
সুহান অবাক হয়ে লক্ষ করল সে আবার মনে মনে কথা বলতে শুরু করেছে। নিজেকে নিজে বলছে, কে আবার কথা বলছে?
তুমি। তুমি তোমার সাথে কথা বলছ।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সুহান ছটফট করে বলল, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
না তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ না।
তা হলে?
সুহান তুমি ধৈর্য ধর। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখ–তুমি সবকিছু বুঝতে পারবে।
কখন বুঝতে পারব?
সময় হলেই বুঝতে পারবে।
কখন সময় হবে?
তুমি সেটা জানবে। এখন তুমি উত্তেজিত হয়ো না। ব্যস্ত হয়ো না। তোমার ওপর খুব বিপদ। তোমাকে নিয়ে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, কাজেই তুমি খুব সাবধানে থেকো। তোমার চারপাশে যারা আছে তারা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের থেকে সাবধান।
সুহান অসহায়ের মতো নিজেকে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তার মস্তিষ্কের ভেতরে কেউ একজন বলল, তুমি সব বুঝতে পারবে। একসময় তুমি সবকিছু বুঝতে পারবে। এখন তুমি বিশ্রাম নাও।
আমার মাথার ভেতরে শত শত মানুষ কথা বললে আমি কেমন করে বিশ্রাম নেব?
তোমাকে বিশ্রাম নেওয়া শিখতে হবে। শত মানুষের কথার মাঝে বিশ্রাম নেওয়া শিখতে হবে। আমরা তোমাকে সাহায্য করব।
তোমরা কারা?
আমরা আর তুমি এক। কী বলছ তুমি?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারবে। একসময় বুঝতে পারবে। তুমি ডাক্তারকে বোলো তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।