দাড়াও। বাজখাই গলায় একটা ধমক শুনে সুহান থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সামনে প্রায় পাহাড়ের মতো উঁচু একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অবিশ্যি দাঁড়িয়ে আছে কথাটা বলা হয়তো একটু ভুল হবে, বলা উচিত দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে, মানুষটা জড়িত গলায় বলল, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, ঝটপট একটা ইউনিট বের করে দাও দেখি।
সুহান খুব বিরক্ত হল, সত্যি সত্যি একটা ইউনিট দিয়ে দেবে নাকি এই নেশাগ্রস্ত মানুষের নেশার খোরাক না যুগিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে সেটা একবার চিন্তা করল। মানুষটা বিশাল, ইচ্ছে করলে তাকে জাপটে ধরে নতুন আরেকটা সমস্যা করতে পারে তাই সে একটা ইউনিট দিয়ে দেওয়াই ঠিক করল। ইউনিটটা বের করার জন্য সে যখন পকেটে হাত ঢুকিয়েছে ঠিক তখন সে অবাক হয়ে দেখল আরো তিন জন মানুষ তাকে ভিন্ন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
এই তিন জন মানুষ নেশাগ্রস্ত মানুষষ্টার মতো টলছে না, তারা কেউ নেশাগ্রস্ত নয়। সুহান হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, তোমরা কারা?
তিন জন মানুষ কোনো উত্তর দিল না, তারা আরো কাছাকাছি এগিয়ে এল এবং তখন সে তাদের হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্রগুলো দেখতে পেল। এ ধরনের বিপদের মুখোমুখি হলে কী করতে হয় সে গত কয়েক সপ্তাহ থেকে কিরির কাছে শিখছে, সেই বিদ্যেটুকু কাজে। লাগানোর জন্য সে লাফ দিয়ে সামনের মানুষটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই কানের কাছে একজন তাকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছে। মুহূর্তে তার সামনে পুরো জগৎটুকু অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে। সে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল তার আগেই একজন তাকে ধরে ফেলল, সুহান জ্ঞান হারানোর আগে এক মুহূর্তের জন্য মানুষটাকে দেখতে পায় এই মানুষটাকে সে আগে কোথায় জানি দেখেছে।
পাহাড়ের মতো মানুষটা ব্যাকুল গলায় আরো একবার বলল, আমার ইউনিট?
কিন্তু সুহান তখন সেটা শুনতে পেল না। অন্য তিন জন মানুষ যে তার অচেতন দেহটাকে নিয়ে কাছাকাছি একটা কালো ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছে সেটাও সে জানতে পারল না।
মিলিনার সরাইখানায় মিলিনা অনেক রাত পর্যন্ত সুহানের জন্য অপেক্ষা করল। সুহান নামের এই ছেলেটার জন্য তার ভেতরে এক ধরনের মমতার জন্ম হয়েছে ছেলেটি ফিরে
আসায় সে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের আশঙ্কা অনুভব করতে থাকে। কিন্তু সে জানে। তার কিছু করার নেই। পুলিশ বা হাসপাতালে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের খোঁজ নেওয়া যায় না।
সুহানের জ্ঞান ফিরে এল ছাড়া ছাড়া ভাবে। তার মনে হতে লাগল অসংখ্য মানুষ তার সাথে কথা বলছে, সেই কথাগুলো সে মাঝে মাঝে পরিষ্কার বুঝতে পারে আবার মাঝে মাঝে তার কাছে পুরোপুরি দুর্বোধ্য মনে হয়। কথাগুলো কে বলছে সে বুঝতে পারে না। কখনো কখনো মনে হয় সে নিজেই এই কথা বলছে। যে কথাগুলো তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খায় তার মাঝে ক্যাটাগরি-বি., অস্তিত্ব, ভবিষ্যৎ, গোপনীয় রিপোর্ট এ ধরনের বিষয়গুলোই বেশি। জ্বরাক্রান্ত মানুষের মাথার মাঝে কোনো একটা ভাবনা যেরকম ঘুরপাক খেতে থাকে অনেকটা সেরকম, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি জীবন্ত।
সুহান ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাতেই তার ওপর একজন ঝুঁকে পড়ল, মানুষটা একজন ডাক্তার। সুহান ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?
তুমি হাসপাতালে। শহরতলি এলাকায় তোমাকে কজন নেশাগ্রস্ত মানুষ আক্রমণ করেছিল।
সুহান বলতে চাইল, না, আমাকে নেশাগ্রস্ত মানুষ আক্রমণ করে নি, যারা আক্রমণ করেছিল তারা প্রফেশনাল, তাদের হাতে অস্ত্র ছিল এবং তাদের একজনকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। কিন্তু তার কিছুই বলার ইচ্ছে করল না, সে নিঃশব্দে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার বলল, তোমার মাথায় আঘাত লেগেছিল এবং তোমাকে বাঁচানোর জন্য তোমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
সুহান হতচকিতের মতো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে? সে একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ, তাকে বাচানোর জন্য তার মাথায় অস্ত্রোপচার করেছে? কেন?
মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার একটা জটিল বিষয়। ডাক্তার তার ওপর ঝুঁকে পড়ে মৃদুস্থার বলল, প্রথম প্রথম সেজন্য তোমার বিচিত্র কিছু অনুভূতি হবে, তুমি সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।
সুহান ফিসফিস করে বলল, দুশ্চিন্তা করব না?
না! তোমার কেমন লাগছে, কী হচ্ছে, কী রকম অনুভব করছ সবকিছু আমাদের বলবে। আমরা তোমাকে সাহায্য করব।
ধন্যবাদ। সুহান হঠাৎ এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে, তার আর কথা বলার ইচ্ছে করে না। সে চোখ বন্ধ করল। ডাক্তার বলল, তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়া দরকার। আমি একটা ইনজেকশন দিই, তুমি ঘুমিয়ে যাও।
সুহান গভীর ঘুমে ঢলে পড়ার আগে শুনতে পেল কে যেন তার মস্তিষ্কের মাঝে বলছে, সাবধান। সুহান তুমি সাবধান! তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ভয়ংকর ষড়যন্ত্র।
কে তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, কীসের ষড়যন্ত্র কিছু বোঝার আগেই সুহান গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
সুহান তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন মানুষ। তাদের সবাই যদিও সাদা পাউন পরে আছে কিন্তু বোঝা যায় সবাই ডাক্তার নয়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর। মধ্যবয়স্ক একজন বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে আমাদেরকে বলো।
আমার মাথার মাঝে মনে হয় অনেক মানুষ কথা বলছে।