সুহান কোনো কথা বলল না, মানুষটি আবার তার কী-বোর্ডে ঝুঁকে পড়ে শেষ মুহূর্তের মতো কিছু কাজ করতে শুরু করে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই অনেকগুলো সশস্ত্র মানুষ ছুটে আসে, সুহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তারা ভেতরে ঢুকে যায়, সবার সামনে রয়েছে। বিগা, তার হাতে একটা ছোট আগ্নেয়াস্ত্র। রিগা কোনো রকম দ্বিধা না করে মানুষটার কাছে এগিয়ে যায় এবং একটা কথাও না বলে মানুষটাকে গুলি করল। পরপর অনেকবার।
সুহান এর আগে কখনো কোনো মানুষকে হত্যা করতে দেখে নি, দৃশ্যটা তার কাছে ভয়ংকর অমানবিক এবং পৈশাচিক বলে মনে হল। নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করে ছুটে যায় এবং গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। মানুষটার রক্তে তার হাত মাখামাখি হয়ে যায়, সে চিৎকার করে বলতে থাকে, না! না! না!
কে একজন হ্যাচকা টান দিয়ে সুহানকে সরিয়ে নেয়। বেশ কয়েকজন মানুষ গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে ঘিরে দাড়ালে তার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা পরীক্ষা করতে থাকে। সুহান শুনতে পেল, কেউ একজন বলছে, না। কোনো পরিচয় নেই।
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, সার্ভার থেকে কী তথ্য বের করেছে?
জানি না। শেষ মুহূর্তে সবকিছু মুছে দিয়েছে।
কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, মুছে দেবার সময় পেয়েছে?
হ্যাঁ। অনেক সময় পেয়েছে।
আরো আগে গুলি করা উচিত ছিল।
সুহান ফ্যালফ্যাল করে মানুষগুলোর দিকে তাকাল তার ক্লারো আগেই গুলি করা উচিত ছিল? একজন মানুষকে গুলি করা কি এতই সহজ?
সুহানকে কে যেন হাত ধরে টানছে। সুহান মাথা ঘুরিয়ে দেখল কিরি। কিরি বলল, চলে এস সুহান। তোমার এখন আর করার কিছু নেই।
সুহান হতচকিতের মতো কিরির দিকে তাকিয়ে বলল, ম্মানুষটাকে মেরে ফেলল?
কিরি বলল, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। চল। এখান থেকে চল। সুহান কিরির পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে, তার তখনো পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সে যদি এভাবে মানুষটাকে খুঁজে বের না করত তা হলে হয়তো তার এভাবে মারা যেতে হত না। সুহান জোর করে পুরো ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পারে না। ঘুরেফিরে বারবার হত্যা-দৃশ্যটা তার মাথায় আসতে থাকে, মনে হয় এটা দীর্ঘদিন তাকে তাড়না করিয়ে বেড়াবে। করিডোরের মোড়ে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে। যারা যাচ্ছে কিংবা আসছে তাদের সবার পরিচিতি পরীক্ষা করে দেখছে। সুহান তার কার্ড দেখিয়ে যখন তার জিনেটিক মাপিঙের জন্য ছোট যন্ত্রটার ভেতরে ভার আঙুল প্রবেশ করিয়েছে তখনই একটা বিপদ সংকেত শুনতে পেল। যন্ত্রের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা হাতের অস্ত্র উদ্যত করে বলল, তুমি কে? এখানে কোথা থেকে এসেছ? তোমার কার্ডের সাথে পরিচয় মিলছে না কেন?
সুহান অবাক হয়ে বলল, পরিচয় মিলছে না?
না। এই দেখ!
সুহান অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি মনিটরে কিছু বিদঘুটে সংখ্যা এবং তথ্যকেন্দ্রে তথ্য নেই বলে একটা লেখা বড় বড় করে ফুটে উঠেছে। সুহান যন্ত্রটা থেকে তার হাত বের করে হঠাৎ করিণটা বুঝতে পারল। বলল, বুঝেছি। আমি গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে ধরেছিলাম বলে আমার হাতে তার রক্ত লেগেছে। সেই রক্ত থেকে জিনেটিক কোডিং করে ফেলেছে–আমার টিস্যু দিয়ে নয়।
যন্ত্রের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, তুমি তোমার আঙুলটা পরিষ্কার করে আবার পরীক্ষা কর।
সলভেন্ট দিয়ে আঙুল পরিষ্কার করে সুহান আবার তার জিনেটিক কোডিং বের করল, এবারে কোডিংটুকু তার কার্ডের তথ্যের সাথে মিলে গেল। উদাত অস্ত্র হাতের মানুষটা তার অস্ত্র নামিয়ে বলল, চমৎকার। এবারে তুমি যেতে পার।
সুহান বলল, ধন্যবাদ।
কিরি আর সুহান হাঁটতে থাকে। কিরি কিছু একটা বলছে, সুহান ঠিক ভালো করে শুনছে। তার মনটা হঠাৎ করে খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ মানুষটার রক্ত থেকে ভুল করে জিনেটিক কোডিং বের করা তথাটা সে একনজর দেখেছে। সেখানে কিছু বিদঘুটে সংখ্যা ছিল, বড় করে লেখা ছিল তথ্যকেন্দ্রে তথ্য নেই কিন্তু তার সাথে আরো একটা জিনিস লেখা ছিল। লেখা ছিল ক্যাটাগরি-বি. মানুষ! এই মানুষটা কে তার পরিচয় কেউ জানে না, শুধু জানে যে সে একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। সুহান কিছুতেই বুঝতে পারে না একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ কেমন করে এত সুরক্ষিত একটা তথ্যকেন্দ্রে চলে এসেছিল? মানুষটা এত সহজে কেমন করে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছে? সে যদি কোনো গোপন তথ্য সগ্রহ করতে এসে থাকে তা হলে একবারও সে সেই তথ্য নিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করল না কেন?
তোমার কী মনে হয়েছে?
সুহান হঠাৎ করে চমকে উঠে লক্ষ করুল কিরি তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছে, প্রশ্নটা পুরোপুরি শুনতে পায় নি। সে লজ্জা পেয়ে বলল, আমি ঠিক খেয়াল করি নি তুমি কী জিজ্ঞেস করেছ?
আজকে রিগাকে দেখে তোমার কী মনে হয়েছে?
মনে হয়েছে মানুষটা একটা পেশাদার খুনি।
সেটা তো সবাই জানে। আর কিছু মনে হয় নি?
না, আমার আর কিছু মনে হয় নি। শুধু–
শুধু কী?
শুধু মনে হয়েছে আমি যেন কখনো তার মতো না হয়ে যাই। এত সহজে মানুষ দূরে থাকুক আমি যেন একটা পতঙ্গকেও কখনো হত্যা করতে না পারি।
কিরি কোনো কথা না বলে একবার সুহানের দিকে তাকাল তারপর নিচু গলায় বলল, পৃথিবী বড় কঠিন একটা জায়গা সুহান।
০৫.
পাতাল ট্রেনের স্টেশন থেকে বের হয়ে সুহান আধো অন্ধকার রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ক্যাটাগরি-বি. মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই এলাকাটাকে তার অত্যন্ত নিরানন্দ মনে হত, ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ইদানীং সারা দিন কাজ করার পর সে ভেতরে ভেতরে তার নিজের জায়গায় ফিরে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই এলাকার মানুষজনের সাথে পরিচয় হয়েছে, কারো কারো সাথে তার আন্তরিক সম্পর্কও হয়েছে। আধো অন্ধকার রাস্তায় ভাঙা কাচ, কাচের বোতল বাচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।