সুহান প্রকৃত অর্থে কখনো বিশ্বাস করে নি সত্যি সত্যি সে একজন দুবৃত্তকে ধরে ফেলবে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল তার একটা কল্পনা। তাই যখন একদিন মাঝরাতে সে দোতলায় নিরাপত্তার অবলাল রশ্মিটাকে অকেজো দেখতে পেল সে খুব দুশ্চিন্তিত হল না, ইলেকট্রনিক্স এবং যন্ত্রপাতি যত নিখুঁতভাবেই তৈরি করা হোক সেগুলো কখনো না কখনো অকেজো হয়ে যায়। এটাও নিশ্চয়ই সেরকম একটা কিছু। কাছাকাছি সার্কিট ব্রেকারের কাছে গিয়ে দেখল সেটাও বন্ধ হয়ে আছে। পরপর দুটো স্বল্প সম্ভাবনার ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম এবং তখন সে দুশ্চিন্তিত হয়ে চারতলায় ছুটে গেল এবং বড় করিডোরে গিয়ে দেখতে পেল টেলিভিশন ক্যামেরাটা ছাদের দিকে মুখ করে রাখা আছে—এই করিডোের দিয়ে গোপনে কোনো মানুষ যেতে চাইলে ক্যামেরাটা এভাবে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুহান করিডোরের শেষ মাথায় তাকাল এবং আবিষ্কার করল দরজার ফাঁক দিয়ে আলো বের হচ্ছে। এটা তথ্যকেন্দ্রের একটা মূল কক্ষ, বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ এখানে ঢোকে না। এবং সারাক্ষণই এই ঘরের জালো নেভানো থাকে। কেউ ভেতরে থাকলে এর ভেতরে আলো জ্বলার কথা কিন্তু এর ভেতরে এখন কেউ নেই। সুহান কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না, নিরাপত্তা কেন্দ্রে ব্যাপারটা জানানোর আগে সে দরজাটা একটু ধাক্কা দিয়ে আসতে চায়–দরজাটা নিশ্চিতভাবেই বন্ধ থাকার কথা। সুহান নিঃশব্দে দরজাটার কাছে গিয়ে খুব আস্তে দরজাটায় ধাক্কা দিল, কারণ একটু জোরে চাপ পড়লেই এলার্ম বেজে উঠবে। সুহান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল যখন তার হাতের স্পর্শে খুব ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেল। সুহান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যে এই গভীর রাতে কোনো একজন মানুষ তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে। সুহান দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল, উঁকি দিয়ে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে দেখল, ঘরের মাঝামাঝি একটা চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একজন মানুষ কাজ করছে। কী-বোর্ডে তার হাত দ্রুত নড়ছে। তাকে দেখে মনে হতে পারে সে এখানেই থাকে এবং এখানেই কাজ করে। সুহান বজ্রাহত মানুষের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রইল, হাতে অস্ত্রটা নিতেও মনে থাকল না। মানুষটা মুখ তুলে সুহানের দিকে তাকাল এবং একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার, তাকে দেখে মানুষটা চমকে উঠল না। এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, সুহানের মনে হল মানুষটা যেন খুব পরিচিত। একজনের মতো তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সুহানের হঠাৎ সাংবিৎ ফিরে এল, সে চোখের পলকে হাতে অস্ত্রটা নিয়ে সেটা মানুষটার মাথার দিকে তাক করে বলল, তুমি কে?
মানুষটা হাসার চেষ্টা করে আবার মনিটরে চোখ নামিয়ে নিয়ে কী-বোর্ডে কাজ করতে থাকে। কী-বোর্ডে কাজ করতে করতে বলল, আমি কে শুনে তুমি কী করবে? তুমি কি আমাকে চিনবে?
তুমি এখানে কেমন করে এসেছ?
মানুষটা চোখ না তুলে কী-বোর্ডে কাজ করতে করতে বলল, একটু ফন্দিফিকির করে এসেছি।
মানুষটা পরিচিত মানুষের মতো কথা বলছে যেন অনেকদিন থেকে তার সাথে পরিচয়। সুহানের এখন রেগে যাওয়া উচিত, কাজেই সে খুব রেগে যাবার ভঙ্গি করে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ? মানুষটা সুহানের দিকে চোখ না তুলে কী-বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কাজ করতে করতে বলল, সেটা তোমাকে বোঝানো খুব সহজ হবে না!
সুহান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটায় একটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, তুমি এখনই এখান থেকে বের হয়ে আস, তা না হলে কিন্তু আমি গুলি করতে বাধা হব।
মানুষটা মাথা নেড়ে ভালো মানুষের মতো বলল, উহুঁ। আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। গুলি করার হলে তুমি এতক্ষণে গুলি করে দিতে। আমার ধারণা তুমি আগে কখনো কাউকে গুলি কর নি।
আমি সেই তথ্যটা তোমাকে দিতে বাধ্য নই। তুমি এখনই তোমার দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও।
মানুষটা সুহানের কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করে কাজ করে যেতে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে মোটামুটিভাবে কারে একটা পর্যায় শেষ করে ফেলেছে। তার মুখে বেশ পরিতৃপ্তির একটা ভাব ফুটে ওঠে, মনিটরে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে সে বেশ আনন্দের একটা ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে থাকে। সুহান চিৎকার করে বলল, তুমি এখনই হাত তুলে দাড়াও তা না হলে কিন্তু গুলি করে দেব।
মানুষটা আবার কী-বোর্ডে ঝুঁকে বলল, তুমি গুলি করবে না। কারণ তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখান থেকে গুলি কলে পেছনের মূল্যবান সার্ভারের বারোটা বেজে যাবে। তোমার সেই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।
সুহান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, সত্যি সত্যিই একজন মানুষ মধ্যরাতে একটা গোপন তথ্যকেন্দ্রের ভেতরে এসে এভাবে কাজ করে যাচ্ছে? যার বুকের ভেতর বিন্দুমাত্র ভয় নেই? পুরো ব্যাপারটাকে একটা তামাশা হিসেবে নিয়েছে?
সুহান কী করবে বুঝতে না পেরে ওয়্যারলেস সেটের বোতাম চাপ দিয়ে কিরির সাথে যোগাযোগ করল, কিরি।
কী ব্যাপার সুহান?
পাঁচ তলার মূল সার্ভার রুমে একজন মানুষ।
কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি ঠাট্টা করছ, তাই না?
না।
মানুষটা কী করছে?
সার্ভারের ইন্টারফেসে কাজ করছে?
তুমি কী করছ?
আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে রেখেছি।
কিরি নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, তুমি তাক করে রাখ, আমি ব্যবস্থা করছি।
সুহান অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রেখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণের মাঝেই এলার্ম বেজে উঠতে থাকে। চারপাশে উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠে এবং অনেক মানুষের পদক্ষেপ শোনা যায়। কী-বোর্ডে ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে প্রথমবার একটু বিচলিত হতে দেখা গেল, একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সময় তা হলে শেষ। কী বলো?