তবে তার কাজটা খারাপ নয়। এই তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য অসংখ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, শুধু সেগুলোর ওপরে ভরসা না করে কিছু মানুষকেও বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা ইতস্তত এই তথ্যকেন্দ্রে ঘুরে বেড়ায়। সুহান সেরকম একজন মানুষ–যদিও সে পুরো দলের মাঝে একেবারেই নিচের সারিতে। বলা যেতে পারে অন্যদের ফাইফরমাশ খাটাই হচ্ছে তার আসল কাজ, কিন্তু সেটা নিয়ে সুহানের এতটুকু ক্ষোভ নেই। বিল্ডিঙের সব জায়গায় সে যেতে পারে না, তাকে সে অধিকার দেওয়া হয় নি। কিন্তু যেখানে তার যাবার অধিকার আছে সেখানে সে খুব উৎসাহ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিরাপত্তা বাহিনীর অন্য সদস্যদের কাছে তার এই বাড়াবাড়ি উৎসাহ এক ধরনের কৌতুকের বিষয়। সুহান সেটা নিয়ে কিছু মনে করে না–প্রথমদিন রিগার সাথে সেই ভয়ংকর সাক্ষাতের পর তার সাথেও সুহানের আর দেখা হয় নি। এখানে তার সময় মোটামুটি খারাপ কাটছে না। এই সপ্তাহের বেতন পাওয়ার পর সে কিছু উপহার কিনে তার অনাথাশ্রমে পাঠিয়েছে। লারার জন্য একটা পারফিউম, কুরাকের জন্য গানের অ্যালবাম, অন্যদের কারো জন্য শুকনো ফল, কারো কারো জন্য চকোলেট আর হালকা পানীয়। উপহারগুলো পৌঁছানোর পর সেখানে কেমন আনন্দের বান ডেকে যাবে সেটা সে এখানে বসেই দেখতে পায়।
থাকার জন্য সে আর কোনো বাসা বা অ্যাপার্টমেন্ট খোঁজ করছে না, মিলিনার সরাইখানাতেই একটা রুম পাকাপাকিভাবে নিয়ে নিয়েছে। মিলিনা যদিও কোনোভাবেই প্রকাশ করে না কিন্তু সুহানের ধারণা এই মধ্যবয়স্ক বদমেজাজি মহিলাটা তাকে পছন্দই করে। স্থানীয় অনেকের সাথে তার পরিচয় হয়েছে, কেউ কেউ বুদ্ধিমান, কেউ কেউ হিংসুটে, কেউ কেউ উদাসী আবার কেউ কেউ ভয়ংকর হতাশাগ্রস্ত। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক, কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু করা যাবে কি না সে ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে সংগঠিত হতে হয়, কিন্তু এখানে কেউ সংগঠিত নয়, সংগঠিত হবার মতো তাড়না কারো ভেতরে নেই। তবে পুরোটাই যে হতাশাব্যঞ্জক তা নয়, মনে হয় এর ভেতরেও কোথায় জানি আশার আলোর আছে। পৃথিবীর অনেক মানুষ জিনেটিক কোড দিয়ে মানুষকে বিভাজন করার বিরুদ্ধে। সবাই জানে একদল বিজ্ঞানী এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন। বিজ্ঞানীদের সেই রিপোর্টটাতে কী আছে তাই সেটা নিয়ে সবার খুব কৌতূহল। এখানে সবার ধারণা বিজ্ঞানীদের প্রকৃত রিপোর্টটা প্রকাশ করা হবে না এবং বিজ্ঞানীদের দলনেতাকে এর মাঝে মেরে ফেলা হয়েছে। আসলে কী হয়েছে কেউ সেটা জানে না। সুহান ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না কিন্তু তার মনে হয় কিছু কিছু মানুষ খুব গোপনে সংগঠিত হচ্ছে তারা খুব বড় একটা কিছু করতে চাইছে। কিন্তু কারা কীভাবে এটা করছে কিংবা আসলেই কেউ এটা করছে কি না সুহান কোনোভাবেই সেটা নিশ্চিত হতে পারছে না। যতদিন সে ধরনের কিছু না হচ্ছে সে কঁাধে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে থাকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে ঘুরতে থাকবে। যদি কখনো তাদের বিরুদ্ধে আইন পাস করে নেওয়া হয় সে তার কাজ ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর অন্যসব ক্যাটাগরি-বি. মানুষের সাথে চলে যাবে। আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করবে। নতুন করে তাদের সভ্যতা তৈরি করতে শুরু করবে। তার কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার ক্ষমতা ছিল, সে কি আর ক্যাটাগরি-বি. শিশুদের পড়াতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে, একটা জীবন সে দেখতে দেখতে কাটিয়ে দেবে।
যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন সে এই তথ্যকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াবে। পুরো তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টাকে সে একটা ধাধা হিসেবে বিবেচনা করছে। কোথায় কোথায় ক্যামেরাগুলো আছে, মোশান ডিটেক্টরগুলো আছে সে পরীক্ষা করে দেখে। কোন সিগন্যালটা থেকে কোন সিগন্যালটা শুরু হয় সে বোঝার চেষ্টা করে। এর মাঝেই সে কিছু কিছু ভুল বের করে ফেলেছে কিন্তু সেটা কিরি ছাড়া আর কাউকে বলে নি। কিরি শুনে হা হা করে হেসে বলেছে, সিস্টেমে ভুল থাকলে থাকুক সেটা যাদের ঠিক করার কথা তারা ঠিক করবে। তুমি কি ভেবেছ আমরা সেটা রিপোর্ট করলে তারা বিশ্বাস করবে? সত্যি সত্যি যদি সিস্টেমে গোলমাল থাকে আর তুমি সেটা বের করে ফেল তা হলে চেপে যাও! ওরা জানতে পারলে তোমার চাকরি চলে যাবে।
সুহান বলল, আমার কেন চাকরি যাবে? আমি কী করেছি?
তুমি ভুলটা বের করেছ। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভুল বের করা খুব বড় অপরাধ। বুঝেছ?
সুহান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
কিন্তু সে যে আসলেই ব্যাপারটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে তা নয়। যারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তারা কেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না? প্রথম দিন রিশার সাথে তার যখন দেখা হয়েছিল তখন সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছিল কারণ রিগাকে সে বুঝিয়েছিল সে নিজে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে খুঁজে তাকে বের করা হয়েছে–আর কী কাকতালীয় ব্যাপার সেটা সত্যি বের হয়ে গেছে! কীভাবে হল ব্যাপারটা? আসলেই কি সে গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? কী করা হবে তাকে দিয়ে? একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ কেমন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়? সুহান কিছু ভেবে পায় না—তখন সে একসময় হাল ছেড়ে দেয়, এই মুহূর্তে তার যেটা দায়িত্ব সেটা নিয়েই মাথা ঘামায়। কাধে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলিয়ে সে তথকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনের করিডোরে করিভোরে ঘুরে বেড়ায়। যেসব জায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা দুর্বল সেসব জায়গায় সে একটু বেশি সময় দেয়। হঠাৎ করে কেউ যদি তথ্যকেন্দ্রে চলে আসে সে তাকে ধরে ফেলতে চায়, ধরে ফেলে প্রমাণ করতে চায় ক্যাটাগরি-বি. মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মানুষ নয়। তাদেরকে হেলাফেলা করা যায় না।