রিশি এগিয়ে আসে, কী হয়েছে?
টিরিনা উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি এটা বিশ্বাস করবে না, কিছুতেই বিশ্বাস করবে।
কী বিশ্বাস করব না?
তোমার এই ভয়ংকর পচা গ্ৰহটাতে কোনো একজন মানুষ আটকা পড়ে আছে। সে বিপদ সংকেত পাঠাচ্ছে!
রিশি চোখ কপালে তুলে বলল, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি, এই দেখ। টিরিনা তথ্যকেন্দ্রের মডিউলটি রিশির সামনে খুলে দিল। সত্যি সত্যি সেখানে দেখা যাচ্ছে এই গ্রহটি থেকে কোনো একজন মানুষ চতুর্থ মাত্রার একটা বিপদ সংকেত পাঠাচ্ছে। বিপদ সংকেতটি কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে আসছে না। তার মাঝে বিপদ সংকেতের বিভিন্ন পর্যায়ের কোড রয়েছে, সেটি নিখুঁতভাবে নিরাপত্তাসূচক সংকেত ব্যবহার করছে। বিপদ সংকেতটি খুব দুর্বল। যে পাঠাচ্ছে সে তার শক্তিটুকু অপচয় করছে না, যে পরিমাণ সংকেত না পাঠালেই নয় তার বেশি কিছু পাঠাচ্ছে না।
রিশি আর টিরিনা বিপদ সংকেতটি বিশ্লেষণ করল, যে এখালে আটকা পড়ে আছে তার ভয়াবহ সংকট। খাবার এবং পানীয় শেষ হয়ে গেছে, কোনোরকম জ্বালানি নেই, সঞ্চিত শক্তিও শেষ হয়ে যাচ্ছে। টিরিনা কিছুক্ষণ তথ্যকেন্দ্রের মডিউলটির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, একটা জিনিসের হিসাব মিলছে না।
কী জিনিস?
এই গ্রহে কোনো মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়।
পরিষ্কার সিগন্যাল পাঠাচ্ছে—
সিগন্যাল পাঠানোর কথা নয়।
কেন?
এই গ্রহ থেকে প্রাকৃতিকভাবে কোনো শক্তি আসবে না যতখানি শক্তি নিয়ে শুরু করবে সেটাই সম্বল।
হ্যাঁ। রিশি মাথা নাড়ল, বলল, প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রথম দলটা গিয়েছে। তাদের সাথে যে সাপ্লাই ছিল সেটা খুব বেশি হলে চার বছরের। চার বছরের আগেই ঠিক করা হল গ্রহটা ছেড়ে চলে আসা হবে–।
টিরিনা উত্তেজিত গলায় বলল, এই এখানেই হিসেব মিলছে না—যতবার তাদেরকে উদ্ধার করতে পাঠানো হয়েছে ততবারই অভিযাত্রী দল রয়ে গিয়েছে—ফিরে আসে নি। কিন্তু যে পরিমাণ রসদ জাছে সেটা দিয়ে কিছুতেই তাদের চলার কথা নয়।
রিশি মাথা নাড়ল, কিন্তু চলছে। এই দেখ একজন হলেও সে কোনোভাবে বেঁচে আছে। সে পাগলের মতো বিপদ সংকেত পাঠিয়ে যাচ্ছে।
তার মানে কিছু বুঝতে পারছ?
রিশি বলল, না। তুমি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ।
কী?
আমাদের এই গ্রহে গিয়ে এই উন্মাদ মানুষটাকে উদ্ধার করতে হবে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কেমন করে জান মানুষটা উন্মাদ?
এরকম জঘন্য একটা গ্রহে কোনোরকম খাবার পানীয় ছাড়া একা একা কুড়ি বছর থাকতে হলে যে কোনো মানুষ পাগল হয়ে যাবে।
রিশি বলল, ঠিকই বলেছ। আমি হলে আত্মহত্যা করে ঝামেলা চুকিয়ে দিতাম।
এই মানুষ করে নি, সেই জন্যই বলছি মানুষটা নিশ্চয়ই উন্মাদ। এই গ্ৰহটাকে মোটামুটিভাবে ভালবেসে ফেলেছে।
যে মানুষটা আছে তার পরিচয়টা কী? বের করা যাবে?
উহুঁ। এখন পর্যন্ত অনেকে গিয়েছে, যে কেউ হতে পারে।
রিশি বলল, যাবার আগে মানুষগুলো সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিয়ে যেতে হবে।
হ্যাঁ। আমি তথ্যকেন্দ্র থেকে বের করছি।
আমি তা হলে স্কাউটশিপটা রেডি করি। রিশি কন্ট্রোল রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, একটু আগে তুমি অভিযোগ করেছিলে শুধু হিমঘরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে হয়, জীবনে কোনো উত্তেজনা নেই! এখন কী মনে হচ্ছে জীবনে উত্তেজনা এসেছে?
টিরিনা হাসল। বলল, হ্যাঁ খানিকটা উত্তেজনা এসেছে। মানুষটা একটু খ্যাপা টাইপের মতো হলে উত্তেজনাটুকু আরেকটু বাড়বে।
দূর থেকে গ্রহটাকে যত কদাকার মনে হচ্ছিল কাছে এসে সেটা তার চাইতে অনেক বেশি কদাকার মনে হল। রিশি ঠিকই বলেছিল এই গ্রহের প্রাকৃতিক আলোটা লালচে, পুরো গ্রহটাকে কেমন যেন পচা ঘায়ের মতো মনে হয়। স্কাউটশিপ দিয়ে গ্রহটার ভেতরে নামতে নামতে টিরিনা এক ধরনের বিতুল্লা নিয়ে গ্রহটার দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো একজন মানুষ যদি একা একা এখানে কুড়ি বছর কাটিয়ে দেয় তার নিশ্চিতভাবেই পাগল হয়ে যাবার কথা।
বিপদ সংকেতের সিগন্যালটি খুঁজে বের করে কিছুক্ষণেই তারা একটা বিধ্বস্ত আবাসস্থল খুঁজে বের করে ফেলল। স্কাউটশিপ দিয়ে আবাসস্থলের উপরে দুপাক ঘুরে তারা কাছাকাছি নেমে আসে। বৈরী গ্রহটায় টিকে থাকার উপযোগী মহাকাশচারীর পোশাক পরতে পরতে টিরিনা বলল, রিশি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা নিতে ভুলো না।
কেন?
যে মানুষটা আছে সে কেমন মানুষ আমরা জানি না। যদি বাড়াবাড়ি খ্যাপা ধরনের হয় তা হলে একটু সাবধান থাকা ভালো।
হুঁ। রিশি মাথা নেড়ে বলল, এটাই এখন বাকি আছে একটা মানুষকে উদ্ধার করতে এসে আমরা তাকে খুন করে যাই।
আমি বলি নি তাকে খুন করে যাও। বলেছি একটু সাবধান থাক।
রিশি হাসল। বলল, আমি জানি টিরিনা। তোমার সাথে ঠাট্টা করছি। একটু পরে যখন এই মানুষটার সাথে দেখা হবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তখন কোনো ঠাট্টা-তামাশা করা যাবে না!
মহাকাশচারীর প্রায় আধা কিম্ভূতকিমাকার পোশাক পরে দুজনে পা টেনে টেনে প্রায় বিধ্বস্ত আবাসস্থলের কাছে হাজির হল। পুরোটা প্রায় ধসে আছে—সত্যিকার অর্থে কোনো দরজা নেই। কিছু ইট-পাথর সরিয়ে একটা সুড়ঙ্গ মতন করে রাখা আছে—এটাকেই মনে। হয় দরজা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রিশি গিয়ে সেই দরজায় ধাক্কা দিল, একটু পেছনে। টিরিনা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে রইল। বার কয়েক শব্দ করার পর ঘড়ঘড় করে শব্দ করে একটা গোলাকার দরজা খুলে যায়। রিশি সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকল, পেছনে পেছনে টিরিনা। ভেতরে আবছা অন্ধকার, চারপাশে একটা মলিন বিবর্ণ ভাব, দেখেই কেমন যেন অসুস্থ-অশুভ বলে মনে হয়। ঘড়ঘড় শব্দ করে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়, তারা শুনতে পারল একটা দুর্বল পাম্প ভেতরের বিষাক্ত বাতাস সরিয়ে নিশ্বাস নেবার উপযোগী বাতাস দিয়ে ভরে দিচ্ছে। সহজ কাজটুকু করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল, যে মানুষটি এখানে থাকে সে তার সঞ্চিত শক্তি বাচিয়ে রাখার জন্য কোথাও এতটুকু বাজে খরছ করতে রাজি নয়।