সুহান অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
আমার তাই ধারণা। যাই হোক ওসব পরের ব্যাপার, এখন কাজের কথায় আসি।
তুমি কি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করতে পার?
সুহান হাসল, বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র কোথায় পাব?
বুলেট প্রুফ জ্যাকেট কখনো চোখে দেখ নি?
না।
শরীরের কোথায় খালি হাতে আঘাত করে একজন মানুষকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য অচেতন করে রাখা যায় সেটা সম্পর্কেও তোমার নিশ্চয়ই কোনো ধারণা নেই।
তুমি যদি জিজ্ঞেস কর তা হলে আমি অনুমান করার চেষ্টা করতে পারি।
এর মাঝে অনুমানের কোনো জায়গা নেই।
তা হলে তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না।
কিরি কলল, ঠিক আছে তা হলে তোমার ট্রেনিং শুরু হয়ে যাক।
কখন?
এখন থেকেই। তার আগে চল তোমাকে তোমার থাকার জায়গা দেখিয়ে দিই। মাঝে মাঝে তোমাকে এখানে একনাগাড়ে কয়েক দিন থাকতে হতে পারে তখন এখানে ঘুমাতে পারবে।
চমৎকার।
সুহান তথ্যকেন্দ্র থেকে যখন বের হয়েছে তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। তাকে এখন কিছু খেয়ে রাতে ঘুমানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ছোট একটা রেস্টুরেন্টে কিছু একটা খেয়ে সে ঘুমানোর জন্য একটা সস্তা হোটেল খুঁজতে থাকে। একটু গুছিয়ে নেবার পর তাকে একটা এপার্টমেন্ট বা ঘর খুঁজে নিতে হবে। সুহান আলোকোজ্জ্বল রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের দালানগুলো দেখতে থাকে। একটা হোটেলকে মোটামুটিভাবে বেশ ভালোই মনে হল। সে একটু ইতস্তুত করে ভেতরে ঢুকে যায়। লবিতে ছোষ্ট যন্ত্রটার মাঝে কার্ডটা প্রবেশ করিয়ে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট একটা জানালা খুলে একজন মহিলার মাথা উঁকি দেয়, সুহান?
হ্যাঁ, আমি সুহান।
তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনের নিরাপত্তাকর্মী?
হ্যাঁ। আমি আজ থেকে সেখানে কাজ করছি।
চমৎকার। মহিলাটা মুখে একেবারে মাপা একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?
আজ রাতে থাকার জন্য আমার একটা রুম দরকার।
মনিটরের স্ক্রিনে চোখ রেখে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলল, আমাদের কাছে তিন ধরনের রুম আছে–সুলত, সাধারণ আর ডিলাক্স। সুলভ রুমের ভাড়া— হঠাৎ মেয়েটা থেমে গেল। বলল, তুমি কাটাগরি-বি, মানুষ?
সুহান হঠাৎ অসহায় বোধ করে। সে ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ।
ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হয়ে তুমি সাধারণ মানুষের হোটেলে কেন এসেছ?
আমি বাইরে থেকে এসেছি। এই শহরে আমার কোনো থাকার জায়গা নেই। আমাকে আজ রাতে কোথাও থাকতে হবে।
মহিলাটার মুখটা হঠাৎ খুব কঠোর হয়ে উঠল, বলল, তুমি পৃথিবীতে কী ঘটছে তার কোনো ঘেঁজ রাখ না?
আমার পক্ষে যেটুকু রাখা সম্ভব সেটা রাখার চেষ্টা করি।
ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে আইন করে মানুষের স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে সেটা জান না?
সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আইনটা পাস হয় নি। যতদিন পাল না হচ্ছে আমাদের মৌলিক কিছু অধিকার আছে। মানুষের মৌলিক অধিকার। সুহানের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে। না যে একই দিনে দ্বিতীয়বার তাকে একই জিনিস ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে।
মহিলাটা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ছেলে, তুমি বিষয়টা বুঝতে পারছ না। আমাদের এই হোটেলটা একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তোমাকে আমরা এখানে রাখতে পারব না। যদি জানাজানি হয়ে যায় তা হলে আমার ব্যবসার ক্ষতি হবে।
সুহান আবিষ্কার করল, সে একেবারে নির্বোধের মতো জিজ্ঞেস করে বসেছে, কেন?
আমাদের রান্নাঘরে যদি তেলাপোকা পাওয়া যায়, বাথরুমে যদি ইঁদুর পাওয়া যায় তা হলে যে কারণে ব্যবসার ক্ষতি হয় সেই একই কারণে। বুঝেছ?
সুহান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। সে স্লট থেকে কার্ডটা বের করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, বিষয়টা বুঝিয়ে দেবার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
সুহান হোটেলের জা খুলে বের হতে যাচ্ছিল তখন মহিলাটা তাকে ডাকল, বলল, শোন।
সুহান কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরে দাঁড়াল। মহিলাটা বলল, শহরের বাইরে ক্যাটাগরি-বি. মানুষদের একটা বস্তির মতো এলাকা গড়ে উঠেছে। আমি নিশ্চিত তুমি সেখানে রাত কাটানোর মতো একটা জায়গা পেয়ে যাবে। সাত নম্বর পাতাল রেল দিয়ে যদি শেষ মাথায় নেমে যাও, বাকিটুকু হেঁটে চলে যেতে পারবে।
ধন্যবাদ। সুহান হোটেলের দরজা খুলে বের হয়ে এল।
সুহান দীর্ঘসময় শহরের মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। যতদিন অনাথাশ্রমে ছিল ক্যাটাগরি-বি. মানুষের যন্ত্রণাটা সে বুঝতে পারে নি। অনাথাশ্রমের বাইরে এসে হঠাৎ করে সে এর প্রকৃত গুরুত্বটা বুঝতে পারছে। তার ভেতরে এক ধরনের যন্ত্রণা হতে থাকে, এক ধরনের ক্রোধ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ইচ্ছে হয় কোনো একটা কিছু ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো করে ফেলে, ধ্বংস করে দেয়, গুঁড়িয়ে দেয়।
সুহান অবিশ্যি তার কিছুই করল না, সে সাত নম্বর পাতাল ট্রেনে করে একেবারে শেষ স্টেশনে নেমে যায়। স্টেশন থেকে বের হয়েই সে বুঝতে পারে সে সম্ভবত ঠিক জায়গাতেই এসেছে। আধো অন্ধকারে ঢাকা জরাজীর্ণ শহর। বিধ্বস্ত দালানের উপরে সস্তা নিয়ন আলো, রাস্তার পাশে নেশাসক্ত মানুষ। সুহান অন্যমনস্কভাবে কয়েক পা হেঁটে যায়, একটা ছোট দোকানের বাইরে একজন মানুষ বসে আছে, এক ধরনের নিরাসক্ত দৃষ্টিতে মানুষটা সুহানের দিকে তাকাল। সুহান জিজ্ঞেস করল, এখানে এক রাত থাকার মতো কোনো হোটেল আছে?