সুহান প্রথমবার তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাল, সোনালি চুল এবং নীল চোখ। মানুষটা সুদর্শন, চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে কিন্তু কোনো নিষ্ঠুরতা নেই। মানুষটা বলল, ঠিক আছে রিগা।
তুমি তোমার কাজটা এই ছেলেকে বুঝিয়ে দাও। এখন থেকে তোমরা দুই জন। একসাথে থাকবে। বুঝেছ?
হ্যাঁ রিগা। বুঝেছি।
০৩.
কিরি বলল, তুমি আমাকে একটু ছুঁয়ে দাও তো।
সুহান একটু অবাক হয়ে বলল, আমি? তোমাকে ছুঁয়ে দেব?
কিরি বলল, হ্যাঁ।
কেন?
আমার খুব কপাল খারাপ। তুমি ছুঁয়ে দিলে হয়তো আমার কপালটা একটু ভালো হবে।
সুহান মাথা ঘুরিয়ে কিরির দিকে তাকাল, সে তার সাথে ঠাট্টা করছে কি না বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু না, তার চোখে-মুখে ঠাট্রার কোনো চিহ্ন নেই।
সুহান বলল, তোমার কেন ধারণা হল আমি ছুঁয়ে দিলে তোমার কপাল ভালো হবে?
কারণ আমি আমার জীবনে তোমার চাইতে সৌভাগ্যবান কোনো মানুষ দেখি নি।
সুহান অবাক হয়ে বলল, আমার চাইতে সৌভাগ্যবান কোনো মানুষ দেখ নি?
না। কিরি মাথা নেড়ে বলল, তোমার খুন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তোমার লাশ এখন পলিমারের প্যাকেট করে হিমঘরে নেওয়া উচিত ছিল। তার বদলে তুমি এখন হাঁটছু। কিরি তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও আমাকে ছুঁয়ে দাও।
সুহান কিরির হাতটা ছুঁয়ে বলল, এই যে ছুঁয়েছি। এখন কি তোমার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে?
কিরি একটু হাসল, বলল, সেটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।
আমি জানতাম না সৌভাগ্য চর্মরোগের মতো ছোঁয়াচে। ছুঁয়ে দিলে ঘটে যায়।
আমিও জানতাম না। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।
সুহানের এই মানুষটাকে বেশ পছন্দ হল। তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে এই মানুষটার সাথে থাকবে ভেবে হঠাৎ করে তার মনটা ভালো হয়ে যায়। একটু আগে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিগার সাথে তার যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা এখনো সে ভুলতে পারছে না।
একটা লিফটে করে দুজনে উপরে উঠে এল। বড় করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিরি বলল, আমি জানতাম না তুমি এত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে তোমাকে বেছে আনা হয়েছে।
আমিও জানতাম না।
কিরি অবাক হয়ে বলল, তুমিও জানতে না? তার মানে? তুমি না রিগাকে সেটা বললে?
বাঁচার জন্য বানিয়ে বলেছিলাম।
বানিয়ে বলেছিলে?
সুহান বলল, হ্যাঁ। তুমি আমাকে যতটা সৌভাগ্যবান মনে কর আমি নিজেকে ততটা সৌভাগ্যবান মনে করি না। তাই জান বাঁচানোর জন্য আমাকে মিথ্যে কথা বলতে হয়।
কিন্তু এটা তো মিথ্যা কথা নয়। তোমার সামনেই তো রিগা পরীক্ষা করে দেখল আসলেই তোমাকে সারা পৃথিবী থেকে বেছে আনা হয়েছে।
সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, সেটা দেখেই তো এখন আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। ভেবে পাচ্ছি না কেন আমাকে এনেছে।
কিরি অন্যমনস্কভাবে বলল, ভারি আশ্চর্য!
সুহান বলল, তুমি যদি খুব ভালো করে চিন্তা কর তা হলে দেখবে এটা সেরকম আশ্চর্য নয়।
কেন?
আমার কী মনে হয় জান? সুহান একটু চিন্তা করে বলল, আমার মনে হয় এই তথ্যকেন্দ্রে হয়তো খুব বিপজ্জনক কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা আছে। কেউ হয়তো মারা পড়তে পারে। তাই আমাকে এনেছে, বিপজ্জনক কাজে ব্যবহার করবে, মারা যদি যেতেই হয় তা হলে একটা ক্যাটাগরি-বি. মানুষ মারা যাক।
মারার ন্যই যদি আনতে হয় তা হলে তো সারা পৃথিবী খুঁজে আনতে হয় না। কিরি হঠাৎ করে সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আমাকে একটা জিনিস বল, তুমি কি খুব প্রতিভাবান?
সুহান একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা আমি নিজের সম্পর্কে কেমন করে বলি? আমি তো অনাথাশ্রমে বড় হয়েছি কখনো পড়াশোনা করার সুযোগ পাই নি। নিজে নিজে পড়েছি, ঘরে বসে পরীক্ষাগুলো দিয়েছি।
কেমন হয়েছে পরীক্ষা?
সুহান হাসল, বলল, খুব ভালো। আমি যদি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ না হয়ে তোমাদের মতো একজন হতাম তা হলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যেতাম।
সত্যি? কিরির দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, তুমি সত্যি বলছ?
হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি।
কী ভয়ংকর অন্যায়। তোমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার কথা, জ্ঞানী মানুষদের সাথে কথা বলার কথা, তার বদলে তুমি আমার মতো একজন হতভাগার সাথে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করছ।
সুহান বলল, কিন্তু তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিরি। আমার মনে হয় গোমড়ামুখী বুড়ো প্রফেসরদের সাথে জ্ঞানের কথা বলা থেকে তোমার সাথে কাজ করা। অনেক বেশি আনন্দের হবে।
কিরি বলল, সেটা তুমি আমাকে খুশি করার জন্য বলেছ, সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় করা হয়েছে সেটা তো চলে যাচ্ছে না।
সুহান বলল, ওসব নিয়ে আর কথা না বললাম।
ঠিক আছে তুমি যদি না চাও তা হলে বলব না।
আমাকে তা হলে বলে দাও আমার কী করতে হবে। আমি আগে কখনো কোনো ধরনের কাজ করি নি।
সেটা সমস্যা হবার কথা না। এই তথ্যকেন্দ্রে নিরাপত্তার সকল কাজ করা হয় ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে। যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক এগুলোই সব কাজ করে। আমাদের রাখা হয়েছে একটা বাড়তি স্তর হিসেবে। যন্ত্রপাতির চোখ এড়িয়ে যেতে পারে এরকম কিছু যদি ঘটে যায় সেগুলো দেখার জন্য।
সেরকম কিছু কি ঘটেছে?
কিরি একটু ইতস্তত করে বলল, আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হয় নি কিন্তু আমার মনে হয় ঘটেছে। কয়েকদিন আগে দুর্ঘটনায় দুজন মারা গেছে, কিন্তু আমার মনে হয় সেগুলো দুর্ঘটনা নয়। আমার মনে হয় দুজন মানুষ বাইরে থেকে এই তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে গিয়েছিল।