সুহান একটু বিপন্ন অনুভব করতে থাকে। রিগার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জিব দিয়ে শুকনো ঠোট ভিজিয়ে বলল, আমি সেটা বলি নি। তবে ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে শুধু আইনগত জটিলতার জন্য মানুষ বলা হয় এটা ভুল তথ্য।
আমি নিজে পড়েছি যে তারা বিবর্তনে মানুষ থেকে অনেক পেছনে। তাদের পশু প্রবৃত্তি আছে। এমনকি তাদের শরীরে এখনো পর চিহ্ন আছে।
সুহানের পক্ষে এটাও সহ্য করা সম্ভব হল না, রিগার দিকে তাকিয়ে বলল, পর চিহ্ন বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?
তাদের বেশিরভাগেরই নাকি এখনো ছোট লেজ আছে।
সুহান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না যে সত্যিই এখনো এরকম মানুষ আছে যারা মনে করে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আসলে পণ্ডর কাছাকাছি। সুহান হঠাৎ করে প্রতিবাদ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলুল। এই অমার্জিত এবং ঐ মানুষটার সাথে কথা বলে কী লাভ, সে তো কোনোভাবেই তার সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন করতে পারবে না। সুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল এবং তার নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকাটাকে রিমা আবার এক ধরনের বেয়াদবি হিসেবে বিবেচনা করল। রিগা ভয়ানক মুখভঙ্গি করে বলল, আমরা এখনই সেই পরীক্ষা করে ফেলতে পারি।
সুহান একটু অবাক হয়ে তাকাল, কী পরীক্ষা?
তোমার শরীরে পশুর চিহ্ন আছে কি না।
সুহান তখনো ঠিক বুঝতে পারল না রিগা কী বলতে চাইছে। রিগা কঠোর মুখে বলল, তুমি তোমার কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে দাড়াও।
সুহানের মনে হল তার মাথার ভেতরে একটা ছোট বিস্ফোরণ ঘটে গেল, সে হিংস্র চোখে রিগার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কখনো একজন মানুষকে এরকম নির্দেশ দিতে পার না।
রিগা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, পারি। তুমি আমার আদেশে, আমার নির্দেশে তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে কাজ করবে।
সেটা হবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজ। আমার সম্মান নষ্ট করে তুমি আমাকে কোনো নির্দেশ দিতে পারবে না। আমাদের সংবিধান প্রত্যেকটা মানুষের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে।
সত্যিকারের মানুষের। তোমার মতো ক্যাটাগরি-বি. শিম্পাঞ্জির নয়।
সুহন কঠোর মুখে বলল, আমি ক্যাটাগরি-বি. শিম্পাঞ্জি নই। আর্মি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। একজন মানুষের যত অধিকার থাকার কথা তার অনেক কিছু আমাদের নেই। কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারটা এখনো আছে।
রিগা হুঙ্কার দিয়ে বলল, সেই অধিকারটাও থাকবে না। সেজন্য নতুন আইন পাস করা হচ্ছে।
সুহান একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, যখন সেই আইনটা পাস হবে তখন তুমি বলতে এস। এখন বলো না।
রিগা হঠাৎ চোখ ছোট ছোট করে বলল, তুমি মনে করেছ আমাদের সেই আইনটা পাস করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? তুমি মনে করেছ আমি এখনই তোমাকে উলঙ্গ করতে পারব না?
সুহান পাথরের মতো মুখ করে বলল, না পারবে না।
রিগা হঠাৎ তার ড্রয়ারের তলা থেকে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের করে নিয়ে বলল, পারব না?
সুহান তার শেষ বাক্যটা সংশোধন করে বলল, প্রাণ থাকতে পারবে না।
তুমি জান আমি যদি এই ঘরে তোমাকে গুলি করে হত্যা করে বলি আত্মরক্ষার। জন্য আমার তোমাকে হত্যা করতে হয়েছে তা হলে কেউ আমাকে অবিশ্বাস করবে না?
সুহান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এই ঘরে আরো একজন মানুষ আছে। একই ঘরে একইসাথে ঠিক তোমার মতো চরিত্রের দুই জন মানুষকে পেয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব কম। সে তোমার কথার প্রতিবাদ করতে পারে। সে কাটাগরি-বি, মানুষ নয়, কাজেই সে তোমার মিথ্যে কথা শুনতে বাধা নয়।
তুমি তাই মনে কর? রিগা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা সুহানের দিকে তাক করে ধরে বলল, ঠিক আছে তা হলে সেই পরীক্ষাটাই হয়ে যাক।
সুহান রিগার চোখের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ সেখানে নিশ্চিত মৃত্যুকে দেখতে পায়। মানুষটা সত্যিই তাকে খুন করে ফেলবে, এই মানুষটা উন্মাদ। সুহান হঠাৎ অসহায় অনুভব। করে—তার জীবনটা দ্রুত এত অর্থহীনভাবে শেষ হয়ে যাবে সে কখনো কল্পনা করে নি। সে কি কিছু করতে পারবে না? শুধু মানুষের সম্মান পাবার জন্য তাকে এভাবে মারা পড়তে হবে?
সুহান দেখতে পেল রিগা ট্রিগারে আঙুল রেখে বলল, কেউ তোমাকে রক্ষা করতে আসবে না!
সুহান শেষ চেষ্টা করল, শুধু বেঁচে থাকার জন্য সে শেষ চেষ্টা করল, সম্পূর্ণ আন্দাজের ওপর ভরসা করে বলল, আশা করি, আমাকে খুন করার জন্য তোমার কারণটা যেন যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়। সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে যখন একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আনা হয় তার পেছনে একটা কারণ থাকে।
রিগাকে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখা গেল, সুহান সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে কথা বলছে সেটা খুব সহজে রিগা বুঝতে পারবে না। রিগা বলল, তোমাকে সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে আনা হয়েছে?
আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি খোঁজ নিতে পার?
সুহান ভেবেছিল মানুষটা খোঁজ নেবে না, কিন্তু সে আতঙ্কিত হয়ে দেখল রিগা মনিটরে ঝুঁকে পড়েছে। সুহান বুঝতে পারল সে ধরা পড়ে গেছে, স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের গুলি নাকি মিথ্যে কথা বলে ধরা পড়ার অপমান—কোনটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক হবে?
রিগা মনিটরের দিকে আরো ঝুঁকে পড়ল। হঠাৎ করে তার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, সে যখন মাথা ঘুরিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়েছে তখন সেখানে এক ধরনের বিচিত্র দৃষ্টি, খানিকটা ভয় এবং অনেকখানি বিস্ময়। রিগা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ড্রয়ারের ভেতরে রেখে তার। গালটা নির্মমভাবে চুলকাতে থাকে। তারপর সুহানের পাশে দাড়ানো মানুষটাকে বলল, কিরি, তুমি এই ছেলেটাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।