সশস্ত্র প্রহরী দুজনের একজন তার অস্ত্রটা নাড়িয়ে বলল, এস আমার সাথে।
একজন সুহানের সামনে আরেকজন পেছনে থেকে তাকে নানা করিডোর হটিয়ে একটা ঘরে এনে জির করল। সেখানে রাগী চেহারার একজন মহিলা সুহানের হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে তার যোগাযোগ মডিউলে প্রবেশ করিয়ে দিতেই স্ক্রিনে তার ছবি ফুটে ওঠে। রাগী মহিলাটা ছবির সাথে সুহানের চেহারা মিলিয়ে নিয়ে চোখের রেটিনা স্ক্যান করার জন্য যন্ত্রটা তার দিকে এগিয়ে দেয়, সুহান যন্ত্রটাতে তার চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে রইল, নিশ্চয়ই অবলাল আলোতে স্ক্যান করিয়েছে কারণ কখন স্ক্যান করা হয়ে গেল সে কিছু বুঝতেই পারল না। রেটিনা স্ক্যান করার পর সুহানের শরীর থেকে এক বিন্দু রক্ত নিয়ে ডিএনএ প্রোফাইল করা হল। হাত এবং পায়ের আঙুলের ছাপ রাখা হল, শরীরের ছবি নেওয়া হল, এক্স-রে করা হল এবং পুরো শরীরের অভ্যন্তরীণ ত্রিমাত্রিক ছবি নেওয়া হল। সব শেষ করে রাগী চেহারার মহিলাটা সুহানের কার্ডটা ফেরত দিয়ে বলল, তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন-এ তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সুহান বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। একটু ইতস্তত করে যোগ করল, আমি এই প্রথম কোথাও কাজ করতে এসেছি সেজন্য একটু ভয় ভয় করছে।
রাগী চেহারার মহিলাটার মুখের কাঠিন্য হঠাৎ একটু শিথিল হয়ে আসে, সে নরম হয়ে বলল, জীবনে সবকিছুই কখনো না কখনো প্রথমবার শুরু করতে হয়। তোমার ভয় পাবার কিছু নেই সুহান।
আজ এই প্রযুম কেউ সুহানকে তার নাম ধরে সম্বোধন করল এবং সুহান প্রথমবার নিজেকে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে অনুভব করল। সে কৃতজ্ঞ গলায় বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমার নাম কিরিনা।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কিরিনা।
কিরিনা সুহানের হাতে একটা ছোট প্যাকেট দিয়ে বলল, তুমি এখন তিন শ বারো নম্বর ঘরে রিপোর্ট কর। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিগা সেখানে আছে। সে তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবে।
সুহান আবার কিরিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসে। সুহানের এখনো বিশ্বাস হয় না যে সে এখন তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন-এর একজন নিরাপত্তাকর্মী, সে এখন এখানে স্বাধীনভাবে হেঁটে বেড়াতে পারে। সুহান কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করল একটা দরজার সামনে আসতেই তার পকেটে রাখা কার্ড থেকে সিগন্যাল পেয়ে করিডোরের দরজাগুলো নিজের থেকে খুলে যাচ্ছে। সুহান হাঁটাহাঁটি করে তিন শ বারো নম্বর ঘরটা খুঁজে বের করে দরজাটা একটু খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। বড় একটা টেবিলের এক পাশে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বসে নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের সাথে কথা বলছে। এই মানুষটা নিশ্চয়ই রিগা, সুহানকে দরজা খুলে উঁকি দিতে দেখে বলল, কে?
আমি সুহান। আমি আজকে এখানে কাজে যোগ দিয়েছি।
এস। ভেতরে এস।
সুহান ভেতরে ঢুকল। মানুষটা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো দেখি একটা কচি খোকা, এখানে কাজ করবে কেমন করে?
এটা সত্যিকার অর্থে কোনো প্রয়োজনীয় কথা নয় তাই সুহান কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে যদি এখানে কাজের উপযুক্ত মানুষ না হত তা হলে নিশ্চয়ই। তাকে এখানে কাজ করতে পাঠাত না। মানুষটা আবার নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, তোমার নাম কী বলেছ?
সুহান দ্বিতীয়বার তার নাম বলল, সুহান।
আগের কোনো কাজের অভিজ্ঞতা আছে?
না, নেই।
মানুষটা খুব বিরক্ত হবার ভান করে কাছাকাছি রাখা মনিটরে সুহানের প্রোফাইলটা দেখতে শুরু করে। স্ক্রিনে তার ছবি এবং পরিচয় দেখে হঠাৎ সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, আরে! তুমি দেখি ক্যাটাগরি-বি.!
সুহান মাথা নাড়ল। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিগা খানিকক্ষণ চোখ বড় বড় করে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, তুমি এখানে কীভাবে এসেছ?
সুহান দাতে দাঁত চেপে অপমানটুকু সহ্য করে বলল, আমি নিজে থেকে এখানে আসি নি। আমাকে সরকারি দপ্তর থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
মানুষটা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ভুল হয়েছে। নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন হাই সিকিউরিটি তথ্যকেন্দ্র, এখানে বানর-শিম্পাঞ্জি দিয়ে কাজ হবে না। আমার সত্যিকারের মানুষ দরকার।
অপমানে সুহানের কানের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল। সে তবুও অনেক কষ্ট করে অপমানটুকু সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষটা আবার স্ক্রিনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখে বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে বলল, সত্যিই দেখি তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে। কী আশ্চর্য!
মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আগে কখনো ক্যাটাগরি-বি. মানুষ দেখি নি।
এটাও কোনো প্রশ্ন নয়, সুহানকে নিশ্চয়ই এর উত্তর দিতে হবে না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। যে কারণেই হোক, সুহানের চুপ করে থাকার জন্য এই মানুষটা আরো রেগে ওঠে। তার মুখে বিষাক্ত এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল, চোখ ছোট ছোট করে বলল, আমি শুনেছি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আসলে পশুর কাছাকাছি। শুধু আইনগত জটিলতার জন্য তাদেরকে মানুষ বলা হয়।
এত বড় একটা কথা সুহানের পক্ষে চুপ করে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, সে মাথা নেড়ে বলল, এটা সত্যি নয়।
মানুষটা সুহানের কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠল, সে কখনো কল্পনা করে নি সুহান এরকম একটা পরিবেশে তার কথার প্রতিবাদ করবে। রিগা এটাকে তার প্রতি ব্যক্তিগত অপমান ধরে নিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি বলতে চাও আমি মিথ্যা কথা বলছি? আমি নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান লেফটেন্যান্ট রিগা তোমার মতো নগণ্য একটা ক্যাটাগরি-বি. মানুষের সাথে মিথ্যা কথা বলব?