ভেতরে চারদিকে খোপ খোপ অফিস এবং তার ভেতরে মানুষ কাজ করছে। হালকাপাতলা মানুষটা তাকে একটা খোপের দিকে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে সোনালি চুলের একজন মহিলা ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। সুহান তাকে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার কাছে এই চিঠিটা এসেছে, আমাকে বলেছে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে।।
মহিলাটা সবিস্ময়ে বলল, চিঠি? মহিলার কথা শুনে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে মাথা ঘুরিয়ে সুহানের দিকে তাকাল। চিঠি একটা প্রাগৈতিহাসিক বিষয়, আজকাল কোনো কাজেই চিঠি ব্যবহার করা হয় না। মহিলাটা বলল, চিঠি কেন? তোমাকে ভিড়িফোনে জানাল না কেন?
আমার ভিডিফোন নেই।
অতান্ত দরিদ্র মানুষ বা হতভাগা ধরনের মানুষের কখনো কখনো ভিডিফোন থাকে না, তাকেও সেরকম একজন ধরে নিয়ে মহিলাটা বলল, কেন? ভিডিফোন নেই কেন?
সুহান বিষয়টাকে আরো জটিল করে না ফেলে সোজাসুজি বলে দিল, আমি আসলে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ।
মহিলাটা এবারে রীতিমতো চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে বলল, ক্যাটাগরি-বি.?
হ্যাঁ। তা হলে তুমি এই চিঠি কেমন করে পেয়েছ?
এ প্রশ্নের উত্তর সুহানের জানার কথা নয় কাজেই সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলাটা সরকারি চিঠিটা স্ক্যান করিয়ে নেয়, সুহান দেখতে পায় স্ক্রিনে তার ছবি বের হয়ে এসেছে। মহিলাটা কিছুক্ষণ ছবিটা পরীক্ষা করে তার দিকে ডিএনএ প্রোফাইল বের করার ছোট যন্ত্রটা এগিয়ে দেয়। সুহান টিউবে তার আঙুলটা প্রবেশ করাতেই মৃদু একটা খোঁচা অনুভব করে। তার শরীরের টিস্যু নিয়ে সেটা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়ে নেয় যে এই চিঠির বাহক আসলেই যাকে উদ্দেশ করে চিঠি পাঠানো হয়েছে সেই একই মানুষ।
মহিলাটা এবারে সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন এই সাদা বৃত্তের ভেতরে দাড়াও। এখন তোমার ছবি নেওয়া হবে। এগুলো হলোগ্রাফিক ছবি, কাজেই তুমি নড়বে না।
মহিলাটা কথা বলল ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্ট করে, ছোট বাচ্চাদের সাথে একজন বড় মানুষ যেভাবে কথা বলে অনেকটা সেভাবে। মহিলাটা ধরে নিয়েছে সে যেহেতু ক্যাটাগরিবি, মানুষ কাজেই সে নির্বোধ এবং স্বল্পবুদ্ধির, তাকে সবকিছু আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলে না দিলে সে বুঝবে না। সুহান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে এবং শেষ পর্যন্ত মহিলাটা তার হাতে ছোট একটা কার্ড ধরিয়ে দেয়।
সুহান কার্ডটা হাতে নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে যে, দেশের সত্যিকার নাগরিকের মতো তার একটা পরিচয় আছে। পথেঘাটে যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে তোমার পরিচয় তখন তাকে আমতা-আমতা করে কৈফিয়ত দিতে হবে না। সে ইচ্ছে করলে অন্য দশজনের মতো মিউজিয়ামে যেতে পারবে, লাইব্রেরিতে যেতে পারবে এমনকি বড় কোনো দোকানে গিয়ে কিছু উত্তেজক পানীয় কিনতে পারবে। কার্ডের এক কোনায় বেশ বড় বড় করে ক্যাটাগরি-বি. কথাটা লেখা আছে কিন্তু লেখা থাকলেও এটা সত্যিকারের একটা কার্ড।
মহিলাটা বলল, এই কার্ডটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা সব সময় তোমার কাছে রাখবে। কার্ডটা যদি হারিয়ে যায় সাথে সাথে সেটা নিরাপত্তা দপ্তরে জানাবে। এই কার্ডে তোমার হলোগ্রাফিক ছবি, ডিএনএ প্রোফাইল দেওয়া আছে, কাজেই অন্য কেউ এটা ব্যবহার করতে পারবে না। এই কার্ড সাত শ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, পানিতে ভিজলে নষ্ট হবে না, পিএইচ দুই থেকে বারো পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। মেডিকেল ইমার্জেন্সির সময়…।
মহিলাটা তোতাপাখির মতো মুখস্থ বলে যেতে থাকে, তবে কথাগুলো বলল ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্টভাবে যেন সুহানের বুঝতে অসুবিধা না হয়! মহিলাটার কথা শেষ্য হওয়ার পর সুহান তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে আসে। ভেতরে ঢোকার জুনা তার অনেক ঝামেলা করতে হয়েছিল বের হল খুব সহজে। দরজায় কার্ডটা স্পর্শ করানোর সাথে সাথে দরজাটা খুলে যায়, সুহান মাথা উঁচু করে বের হয়ে আসে।
সুহান শহরে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। মানুষজন বাস্তু হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় অফিস। মাঝে মাঝে খানিকটা জায়গা ঘিরে ঘিরে সুদৃশ্য দোকানপাট। পাতাল ট্রেন এসে থামছে—ওপরে মনোরেল, টাক্সি এবং বাস। সুহান ইচ্ছে করলে এসব জায়গায় এখন ঢুকতে পারবে কেউ তাকে থামাবে না। সে ছোট একটা খাবার দোকানে ঢুকে অর্ধেক ইউনিট খরচ করে এক বাটি সুপ আর প্রোটিনে মোড়ানো দুই টুকরো রুটি খেয়ে নেয়। একটা যোগাযোগ কেন্দ্রে ঢুকে আধা ইউনিট খরচ করে সে নিজের জন্য একটা ভার্চুয়াল ঠিকানা তৈরি করে নিল। এখন সে যে কোনো মানুষের কাছে এখান থেকে যোগাযোগ করতে পারবে। রাতটা কোথায় কাটাবে সে জানে না, তবে আগামী দুদিনের মাঝে তার তথ্যকেন্দ্রে। গিয়ে উপস্থিত হওয়ার কথা। সুহান সাত-পাঁচ ভেবে এখনই তার কাজে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। পাতাল ট্রেন স্টেশন থেকে বের হয়ে তাকে প্রায় কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হল। জায়গাটা শহরের বাইরে এবং বেশ নির্জন। পাশাপাশি কয়েকটা নিচু দালানের একটা তার তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন। সে ঠিকানা মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে দরজায় তার কার্ডটা প্রবেশ করাতেই একটা এলার্ম বাজতে থাকে। কিছুক্ষণেই ঘড়ঘড় শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল এবং সুহান দেখল দুজন সশস্ত্র মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সুহান ভয়ে ভয়ে বলল, আমি একটা সরকারি চিঠি পেয়েছি যেখানে আমাকে বলা হয়েছে–