সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে করিভোর ধরে হাঁটতে থাকে। কাল ভোরে সে তার এই অনাথাশ্রম ছেড়ে চলে যাবে। আনুষ্ঠানিকভাবে সে কারো কাছ থেকে বিদায় নেবে না। ছোট একটা ব্যাগে তার কিছু কাপড়, দুই একটা বই, কিছু তথ্য—ক্রিস্টাল, দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে সে এখান থেকে বের হয়ে যাবে। ক্যাটাগরি-বি. মানুষ বলে সে এই অনাথাশ্রম থেকে খুব বেশি বের হয় না, শহরের কোথায় কী আছে সে খুব ভালো করে জানে না। কিন্তু সে খুঁজে বের করে নেবে। তার কাছে কিছু ইউনিট আছে, লারা জোর করে তার একাউন্টে আরো এক শ ইউনিট প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ তার থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। লারা বলেছে তার সরকারি চিঠিটা দেখালে তাকে কোনো ইউনিট ছাড়াই ট্রেনে উঠতে দেবে, স্বল্পমূল্যের হোটেলে থাকতে দেবে, এমনকি রেস্টুরেন্টে খেতেও দেবে। সরকারি চিঠিতে যে তারিখ দেওয়া আছে যে করেই হোক তার ভেতরে অবিশ্যি তাকে সেই তথ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে। সুহান নিশ্চয়ই তার ভেতরে পৌঁছে যাবে। সে অনাথাশ্রমে একা একা বড় হয়েছে, বাইরের পৃথিবী নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু সে জানে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই সে সবকিছু সামলে নিতে পারবে। সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হতে পারে কিন্তু সে জানে সে অনা সবার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না সত্যি, কিন্তু সুযোগ পেলে সুহান সেটা প্রমাণ করে দিতে পারবে। সুহান জানে হয়তো সে জীবনে কখনোই সেই সুযোগ পাবে না, হয়তো কেউ তাকে সে সুযোগটা দেবে না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, জীবনটা তার কাছে যেভাবে আসবে সে সেভাবেই গ্রহণ করবে, সেভাবেই চেষ্টা করবে। সে কখনো চেষ্টা করা ছেড়ে দেবে না। কোনো একটা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে সে পড়েছে সফল হওয়া বড় কথা নয় সফল হওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে বড় কথা। প্রাচীনকালে মানুষ যখন ধর্মকে বিশ্বাস করে সবকিছু কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নিত তখন কি জীবনটা অনারকম ছিল? সুহান বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময় হঠাৎ সে কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কেউ একজন ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।
আহা! এই চার দেওয়ালের মাঝখানে কত দুঃখই না জানি লুকিয়ে আছে।
০২.
অফিসের দরজা বন্ধ। লোকজন তাদের কার্ড ঢুকিয়ে ভেতরে যাচ্ছে এবং আসছে, সুহানের কোনো কার্ড নেই, সে কেমন করে ঢুকবে বুঝতে পারল না। অন্য একজনের পিছু পিছু ঢুকে যাবার চেষ্টা করাটা নিশ্চয়ই একটা বেআইনি কাজ হবে, সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ এরকম একটা কাজের ঝুঁকি নেওয়া মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মোটামুটি সদয় চেহারার একজন মানুষকে দেখে সে এগিয়ে গেল, এই যে একটু শুনুন।
মানুষটা ভুরু কুঁচকে তাকাল এবং মুহূর্তে সদয় মানুষটাকে অত্যন্ত কঠিন চেহারার রূঢ় একজন মানুষ বলে মনে হতে থাকে। সুহান হড়বড় করে বলল, আমার একটু এই অফিসের ভেতরে যাওয়া দৰ্বকার।
দরকার হলে যাও। তোমাকে তো কেউ নিষেধ করছে না।
সুহান ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমার কাছে কোনো কার্ড নেই।
কার্ড নেই? মানুষটার কথা শুনে মনে হল সে যদি বলত আমার মাথা নেই তা হলে সে আরো কম অবাক হত। খানিকক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে বুঝতে না পেরে বলল, কার্ড নেই কেন?
সূহান বিব্রত হয়ে বলল, আমি আসলে কাটাগরি-বি. মানুষ।
ক্যাটাগরি-বি? সুহান লক্ষ করল মানুষটা সাবধানে একটু পিছিয়ে গেছে যেন ক্যাটাগরি-বি. মানুষের এক ধরনের ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ রয়েছে। তুমি যদি ক্যাটাগরি বি, মানুষ হয়ে থাক তা হলে এখানে ঢোকার চেষ্টা করছ কেন?
সুহান তাড়াতাড়ি পকেট থেকে সরকারের হলোগ্রাম দেওয়া চিঠিটা বের করে বলল, এই যে, সরকার এই চিঠিতে আমাকে এখানে এসে যোগাযোগ করতে বলেছে।
মানুষটা চিঠিটা না ছুঁয়ে মাথাটা এগিয়ে দিয়ে চিঠিটা একনজর দেখে বলল, ও!
আপনি যদি ভেতরে সিকিউরিটির একজনকে বলেন একটু আমাকে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে–
ঠিক আছে। বলব। মানুষটা আরেকবার সুহানকে আপাদমস্তক দেখে ভেতরে ঢুকে গেল।
সুহান আবার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, সে কিছুতেই অসহিষ্ণু হবে না, ধৈর্য ধরে সে অপেক্ষা করবে। সমস্ত পৃথিবী একটা অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতির মাঝে ঢুকে গেছে, সে দুর্ভাগা তাই সে এর বাইরে। তাই যতবার সে এই পদ্ধতির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে ততবার ধাক্কা খেতে হচ্ছে। অনাথ আশ্রম থেকে এই পর্যন্ত আসতে তার কি কম ঝামেলা হয়েছে? প্রতিটা পদক্ষেপে তার কাউকে না কাউকে কিছু একটা জবাবদিহি করতে হয়েছে। সম্পূর্ণ অকারণে তাকে নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে। সে হাসিমুখে সব সহ্য করবে, কারণ সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হয়ে সত্যিকারের মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে চায়। অকারণেই সুহান তার মুখ শক্ত করে যখন চতুর্থবার বিল্ডিংটার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার উপরে উঠে এলো তখন হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে যায়। হালকা-পাতলা একজন মানুষ বের হয়ে বলল, এখানে কে ক্যাটাগরি-বি.?
সুহান তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়, আমি।
হালকা-পাতলা মানুষ ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে?
সুহান পকেট থেকে হলোগ্রাম দেওয়া চিঠিটা বের করে আবার পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, কিন্তু মানুষটা তার আগেই বলল, এস। ভেতরে এস।