তোমাকে খুশি করার জন্য তো বলি নি। সত্যি জেনেই বলেছি। লারা সুর পাল্টে বলল, এস, ভেতরে এস এক কাপ কফি খাও।
সুহান ম্লান মুখে বলল, সত্যি তুমি কফি খেতে ডাকছ?
লারা অবাক হয়ে বলল, কেন সত্যি ডাকব না?
তুমি জান না ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে বাসার ভেতরে আনা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ?
লারা স্থির দৃষ্টিতে সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে এই ক্যাটাগরির বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে সুহান। যখন কেউ তোমাকে নিজের মানুষ বলে গ্রহণ করতে চাইবে তখন তোমাকে সেটা গ্রহণ করতে হবে। মনে রেখ এই ভাগাভাগিটা কৃত্রিম, মানুষের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। সরকার এটা করে ফেললেও সত্যিকার অর্থে মানুষ। ভাগাভাগি হয় নি।
সুহান লারার বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি দুঃখিত লারা, আমি আসলে তোমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে চাই নি।
আমি জানি সুহান। লারা ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমার মনে হয় তুমি খুব চমৎকার একটা সুযোগ পেয়েছ। যদি তুমি এই চাকরিটা না পেতে তোমাকে হয়তো সামনের বছরেই ইউরিনিয়াম খনিতে যেতে হত। কিংবা কে জানে তোমার এই সুস্থ সবল শরীর দেখে তোমাকে হয়তো মহাকাশ গবেষণার কোনো পরীক্ষায় ঢুকিয়ে দিত।
সেটা এখনো করতে পারে।
তা হয়তো পারে–কিন্তু তারপরও তুমি এই সুযোগটা পেয়েছ। সামনাসামনি কারো প্রশংসা করতে হয় না, কিন্তু তবু করছি। তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমান, তুমি উৎসাহী আর পরিশ্রমী। তুমি যত তুচ্ছ কাজ দিয়েই শুরু কর না কেন, তুমি উপরে উঠে আসবে। আমি তোমার সাথে বাজি রেখে এ কথাটা বলতে পারি।
সুহান কোনো কথা বলল না, তার মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি এক মুহূর্তের জন্য উঁকি দিয়ে গেল। লারা ভুরু কুঁচকে বলল, কী হল তুমি ওভাবে হাসছ কেন?
সুহান মাথা নেড়ে বলল, তোমার কথা শুনে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি একজন সত্যিকারের মানুষ।
লারা মাথা ঘুরিয়ে তীব্র স্বরে বলল, সুহান তোমাকে জানতে হবে যে তুমি সত্যিই একজন মানুষ। তুমি ক্যাটাগরি-বি হতে পার, কিন্তু ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। অন্য কিছু নও। নিজের ওপরে সেই বিশ্বাসটা রাখতে হবে। বুঝেছ?
সুহান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। আমি দুঃখিত লারা, আমি এরকমভাবে কথা বলছি। আমি আসলেই দুঃখিত।
ব্যস অনেক হয়েছে। এখন আমাকে কফির কৌটাটা নামিয়ে দাও। উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এই কফিটা এসেছে-ভারি চমৎকার খেতে। এর মাঝে দুই ফেঁটা স্নায়ু উত্তেজক নির্যাস দিয়ে দেব, দেখ খাওয়ার সাথে সাথে তোমার মনটা কত ভালো হয়ে যায়।
সুহান মুখে হাসি টেনে বলল, তা হলে দুই ফোটা কেন, বেশি করেই দাও। পারলে পুরো বোতলটাই ঢেলে দাও!
সুহানের কথা বলার ভঙ্গি শুনে লারা হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল—হাসি খুব চমৎকার একটা ব্যাপার, হঠাৎ করে এই ঘরের ভেতরকার গুমট এবং অবরুদ্ধ যন্ত্রণা ও হতাশাটুকু কেটে সেখানে এক ধরনের স্নিগ্ধ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
সুহান একটা পাইন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনাথাশ্রমের বড় দালানটার দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রীহীন নিরানন্দ এই কংক্রিটের দালানটার জন্য সে হঠাৎ এক ধরনের বেদনা অনুভব করে, তার জীবনের বড় একটা অংশ সে এই কংক্রিটের দেওয়ালের ভেতরে কাটিয়ে এসেছে। এখানে আসার আগে সে আরো দুই একটা অনাথাশ্রমে বড় হয়েছে কিন্তু সেগুলোর কথা সে স্পষ্ট মনে কতে পারে না। নিষ্ঠুর ভালবাসাহীন কিছু মানুষের সাথে দীর্ঘ নিরানন্দ দিন, চাপা ভয় এবং আতঙ্ক ছাড়া তার আর কিছু মনে পড়ে না। যে বয়সে শিশুরা মা-বাবার আশ্রয়ে, পরিবারের ভালবাসায় বড় হয় সেই বয়সে সে শিখে গিয়েছিল এই পৃথিবী অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং স্বার্থপর। সে জেনে গিয়েছিল এখানে সে অপাঙক্তেয় এবং অনাকাক্ষিত। তাকে বোঝানো হয়েছিল সে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ, তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, একটা পশুর জীবনের সাথে তার জীবনের কোনো পার্থক্য নেই, তার থেকে বেশি স্বপ্ন দেখার তার কোনো অধিকার নেই। তবু সে স্বপ্ন দেখেছে, তার চারপাশে তার চাইতেও হতভাগ্য যে মানুষগুলো ছিল সে তাদেরকেও স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছিল। খুব যে আহামরি স্বপ্ন তা নয়, কিন্তু আজকের দিন থেকে আগামী দিনটা যে আরো সুন্দর হবে সেই বিশ্বাসের স্বপ্ন।
সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে কুশ্রী কংক্রিটের দালান্টার দিকে এগিয়ে আসে। রাতের অন্ধকারও এই দালানটার দীনতা ঢাকতে পারছে না, কিন্তু তারপরও হঠাৎ করে সুহান এই কদাকার কংক্রিটের দালানটার জন্য এক ধরনের গভীর মমতা অনুভব করে। তার সুদীর্ঘ জীবনের এই আবাসস্থল ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে, সে সম্ভবত আর কখনোই এখানে আসবে না। এই অনাথাশ্রমের মানুষগুলোকে সে আর কখনোই দেখবে না। কিশোর রুদ্রাকের পুরোপুরি অর্থহীন যুক্তিতর্ক তাকে আর শুনতে হবে না। অপরিণত-বুদ্ধি তরুণী দিনিয়ার অর্থহীন হাসির শব্দ শুনে সে আর ঘুম থেকে জেগে উঠবে না। গভীর রাতে কোনো এক দুঃখী মেয়ের ইনিয়েবিনিয়ে কান্নার শব্দ শুনে সে নিদ্রাহীন চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। অপ্রকৃতিস্থ দ্রুমার উন্মত্ত ক্রোধকে সংবরণ করার জন্য তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে স্নায়ু শীতল করার ইনজেকশন দিতে হবে না। সুহান এই দালানের ভেতর থেকে কত দিন বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখেছে, শেষ পর্যন্ত যখন তার স্বপ্নটা সত্যি হবার সময় এসেছে হঠাৎ করে মনে হচ্ছে এই নিরানন্দ দালানটাই বুঝি তার সত্যিকারের আশ্রয়, এখানকার অপরিণত-বুদ্ধি মানুষগুলোই বুঝি তার সত্যিকারের আপনজন।