রাক একটু শঙ্কিত হয়ে বলল, কার সাথে?
নাতালিয়ার সাথে।
রুরাকের চোখে-মুখে প্রথমে অবিশ্বাস এবং হঠাৎ করে এক ধরনের ছেলেমানুষি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি আসলে নাতালিয়ার সাথেই কথা বলতে চাই। একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার কী মনে হয় সুহান, নাতালিয়া কি আমার সাথে কথা বলবে?
নাতালিয়া টেলিভিশনের একটা সস্তা বিনোদন অনুষ্ঠানের নায়িকা, সে সত্যিকার চরিত্র নয়, এনিমেশন করে তৈরি করা হয়েছে কিন্তু রুরা সেটা কখনো ধরতে পারে না। এই কাল্পনিক কমবয়সী মেয়েটার জন্য তার অনুরাগের কথা অনাথাশ্রমের সবাই জানে। সুহান রুককে আশ্বস্ত করে বলল, বলবে না কেন অবশাই বলবে!
নাতালিয়ার সাথে সে ভিডিফোনে কথা বলছে ব্যাপারটা কল্পনা করে রুকু পরিতৃপ্ত মুখে একটা নিশ্বাস ফেলল। সে কোনো বিষয় নিয়েই বেশি সময় চিন্তা করতে পারে না, এবারেও পারল না। আবার সে আগের বিষয়ে ফিরে এসে বলল, এবার তা হলে আমি সবাইকে গিয়ে বলি যে তোমার চাকরি হয়েছে?
তোমার ইচ্ছে রুরাক!
কিছুক্ষণের মাঝেই অনাথাশ্রমের সবাই জেনে গেল যে সুহান একটা চাকরি পেয়েছে। কী চাকরি, কোথায় চাকরি, কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, সে চাকরি পেয়েছে সেটাই বড় কথা। এই অনাথাশ্রমে যারা থাকে তাদের সবাই জিনেটিক দিক দিয়ে ক্যাটাগরি-বি. গ্রুপের। অনেকেই অপরিণত-বুদ্ধির মানুষ, পৃথিবীর জটিল বিষয়গুলো তারা বুঝতে পারে না, কিন্তু তারপরও এটুকু জানে যে চাকরি পেয়ে এখান থেকে চলে যাওয়া বিষয়টা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। যারা এই অনাথাশ্রম থেকে বাইরে যেতে পারে। না তাদের জীবনটা খুব দুঃখের জীবন। যারা এখানে থাকে তারা সেই জীবন নিয়ে কথা। বলতে চায় না। তাই একজন একজন করে অনাথাশ্রমের সবাই সুহানের কাছে এল, তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। যারা খুশি হয়েছে তারা যেরকম তাদের আনন্দটুকু গোপন রাখে নি, ঠিক সেরকম যারা ঈর্ষান্বিত হয়ে আছে তারাও তাদের ঈর্ষাটুকু গোপন রাখল না। সবাই চলে যাবার পর সুহান সরকারের সোনালি রঙের খামটা হাতে নিয়ে বের হয়। অনাথাশ্রমের দেয়ালঘেরা কম্পাউন্ডের এক কোনায় ছোট একটা বাসায় অনাথাশ্রমের ডিরেক্টর লারার বাসা। লারা মধ্যবয়সী হাসিখুশি মহিলা, সুহানকে খুব স্নেহ করে, তাকে খবরটা দেওয়া দরকার।
ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে লারা ভিডিফোনে কার সাথে জানি কথা বলছিল, সুহানকে দেখে ভিডিফোনটা ভাঁজ করে সরিয়ে রেখে বলল, কী খবর সুহান?
লারা, আমি একটা চাকরি পেয়েছি।
সত্যি? লারার চোখে-মুখে আনন্দের ছায়া পড়ল, কী চমৎকার!
সুহান কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল। লারা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, কী হল সুহান—তুমি খুশি হও নি?
সুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ফিসফিস করে বলল, ডাটাবেসের একটা অফিসে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি। বেতন তিন শ বিশ ইউনিট। দুই বছর অবেক্ষণ।
লারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, সুহান, আমি খুব দুঃখিত যে তুমি তোমার ক্ষমতার উপযুক্ত একটা কাজ পেলে না। আমি জানি তুমি একটা কলেজের শিক্ষক হবার ক্ষমতা রাখ, ইচ্ছে করলে তুমি ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতে পারতে
সুহান মাথা নাড়ল, বলল, না লারা, আমি পারতাম না। আমি জিনেটিক গ্রুপে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। এই পৃথিবীতে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের কোনো জায়গা নেই।
লারা চুপ করে রইল, কারণ কথাটা সত্যি। মানুষের জিনেটিক প্রোফাইল দেখে তাদেরকে জিনেটিক-এ, এবং বি, এই দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।
এ ক্যাটাগরির মানুষেরা দেশের প্রকৃত নাগরিক। তাদেরকে লেখাপড়ায় সুযোগ দেওয়া হয়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নির্বাচনের সময় তারা ভোট দিতে পারে, সরকারি চাকরি পেতে পারে, ক্যাটাগরি-বি. গ্রুপের মানুষের কোনো সুযোগ নেই। শোনা যাচ্ছে আইন করে ক্যাটাগরি-বি. গ্রুপের মানুষকে অবমান নামে একটা গোষ্ঠীতে ফেলা হবে, তখন তাদের জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না। তাদেরকে বিপজ্জনক কাজের মাঝে ঠেলে দেওয়া হবে, গবেষণার কাজে তাদেরকে ব্যবহার করা যাবে, এমনকি তাদেরকে কেউ খুন করে ফেললেও কোনো বিচার হবুে না।
সুহান বলল, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ-—আমাকে এই চাকরিটা দেবার পেছনে কোনো একটা কারণ আছে।
কী কারণ?
নিশ্চয়ই এই চাকরিটা মানুষের জন্য খুব বিপজ্জনক তাই এটা আমাকে দিয়েছে। নিশ্চয়ই ছয় মাসের ভেতর আমি মারা পড়ব?
লারা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, কেন তুমি আগেই এরকম করে ভাবছ? হয়তো চাকরিটা ভালো। হয়তো যাদের সাথে কাজ করবে তারাও চমৎকার মানুষ—
সুহান লারাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, হতে পারে, কিন্তু আমি কাটাগরি-বি, মানুষ, আমার সাথে চমৎস্কার হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।
লারার মুখে বেদনার একটা ছায়া পড়ল। সে নিচু গলায় বলল, এই ক্যাটাগরি-এ, আর ক্যাটাগরি-বি.-এর পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে এক ধরনের পাগলামি, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা সত্যিই ঘটে গেছে। তোমার উদাহরণটাই দেখ আমি তো তোমার মতো চমৎকার বুদ্ধিমান মানুষ আগে দেখি নি, অথচ সরকারিভাবে তুমি ক্যাটাগির-বি, মানুষ! রসিকতার তো একটা মাত্রা থাকা দরকার।
সুহান জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ লারা আমার সম্পর্কে এরকম একটা সুন্দর কথা বলার জন্য।