মানুষগুলো একটু দূর থেকে তাদের ভয় পাওয়া চোখে দেখতে থাকে। ছোট ছোট শিশুগুলো বড়দের পেছনে লুকিয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক মানুষটি কঁপা গলায় বলল, সর্বনাশ হয়েছে। প্রাচীনকালের পুরুষ আর নারী চলে এসেছে! এক্ষুনি নিরাপত্তাকর্মীদের ডাক।
নিশি অবাক হয়ে বলল, তোমরা এত অবাক হচ্ছ কেন? তোমরা কি নারী না পুরুষ?
মানুষগুলো কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিশি এবং অশুন বুঝতে পারে মানুষগুলোর চেহারা পুরুষ বা নারী দুইই হতে পারে। তারা আগে কখনো এরকম চেহারার মানুষ দেখে নি। অশুন বলল, তোমরা কথা বলছ না কেন? তোমরা কি পুরুষ না নারী?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, নারী-পুরুষ এইসব আদিম বিভাজন বহুঁ আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন এখানে নারী-পুরুষের মতো কোনো ভাগ নেই। এখানে সবাই মানুষ!
কিন্তু—কিন্তু–
কিন্তু কী?
নারী আর পুরুষ যদি না থাকে তা হলে শিশুদের জন্ম হয় কেমন করে?
শিশুদের জন্ম হয় না। ডিজাইন করে তৈরি করা হয়।
কে তৈরি করে।
আমাদের ল্যাবরেটরিতে।
নিশি কাঁপা গলায় বলল, তোমরা তোমাদের শিশুদের ভালবাস?
কেন ভালবাসব না? আমাদের সবাইকে নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে। বুদ্ধি দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে। তোমরা সেটা বুঝবে না।
কেন বুঝব না? নিশি প্রশ্ন দৃষ্টিতে বলল, না বোঝার কী আছে?
আমরা জানি প্রাচীনকালে মানুষের মস্তিষ্ক অপরিণত ছিল। তারা পুরুষ-মহিলা, সাদাকালো, জাতি-ধর্ম-ভাষা এসব নিয়ে মাথা ঘামাত। এখন আমরা তার ঊর্ধ্বে এসেছি।
কিন্তু–অশুন বলল, কিন্তু–
তোমরা বুঝবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি এক ধরনের ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমার মনে হয় তোমাদের এখনই নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে যাওয়া দরকার।
নিশি এবং অশুন ঠিক তখন এক ধরনের চাপা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেল। তারা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, আকাশপথে নিরাপত্তাকর্মীরা আসছে। নিশি এবং অন একজন। আরেকজনের দিকে তাকাল, তাদের দৃষ্টিতে ঘৃণার সাথে সাথে এই প্রথমবারের মতো আতঙ্কের ছায়া ফুটে ওঠে।
* * * * *
ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নিশি এবং অশুন দীর্ঘদিন বেঁচে ছিল। তাদেরকে একটা ছোট ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি একজনের প্রতি অন্যজনের প্রচণ্ড ঘৃণা তাদেরকে এই দীর্ঘসময় বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল।
০৩. সুহানের স্বপ্ন
১.
সুহান চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল, সোনালি রঙের চতুষ্কোণ বড় খাম, খামের ডান পাশে হলোগ্রাফিক সরকারি সিল। সাধারণ মানুষের মতো তার যদি একটা ভিডিফোন থাকত তা হলে নিশ্চয়ই এরকম বড় একটা খামে করে তার কাছে চিঠি পাঠাত না সরাসরি ভিডিফোনে কথা বলত। ভিডিফোন নেই বলে তার কাছে এরকম একটা চিঠি পাঠাতে হয়েছে, নিশ্চয়ই কত জায়গা ঘুরে ঘুরে তার কাছে চিঠিটা এসেছে। রুরাক কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে চোখ বড় বড় করে বলল, এটা কী?
সুহান বলল, চিঠি। সরকার থেকে এসেছে।
রুরাক অবাক হয়ে বলল, চিঠিঃ কী আশ্চর্য! তারপর আশ্চর্য হবার ভঙ্গি করার চেষ্টা করতে লাগল।
সুহান রুরাকের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে রুরা আসলে আশ্চর্য হয় নি, তার অপরিণত মস্তিস্কের আশ্চর্য হবার ক্ষমতা নেই, সে শুধু স্বাভাবিক মানুষের মতো আশ্চর্য হবার, খুশি হবার এবং দুঃখ পাবার ভঙ্গি করে। রুদ্রাক আরেকটু কাছে এসে বলল, চিঠিটা খোলো, দেখি কী আছে ভেতরে।
সুহান বলল, খুলতে হবে না, আমি জানি ভেতরে কী আছে। রুককে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখায়, সে ঠিক বুঝতে পারছে না সুহান কী বলছে। আমতা-আমতা করে বলল, না খুলেই তুমি জান?
হ্যাঁ। আমি একটা চাকরি পেয়েছি।
চাকরি পেয়েছ? তুমি? রুরাকের মুখে প্রথমে এক ধরনের অবিশ্বাস তারপর হঠাৎ আনন্দের ছাপ পড়ল, সত্যি, তুমি চাকরি পেয়েছ?
হ্যাঁ। চাকরি না দিলে এরকম সরকারি চিঠি আসে না। সুহান একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি কত দিন কত জায়গায় চাকরির জন্য চিঠি লিখেছি—এর আগে কেউ কোনো চিঠির উত্তর দেয় নাই। এই প্রথম চিঠি এসেছে, তার মানে একটা চাকরি।
রুরাককে এবারে সত্যিই উত্তেজিত দেখায়, সে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি সবাইকে গিয়ে বলি?
দাঁড়াও, আগে খামটা খুলে সত্যি সত্যি দেখে নিই!
রুরাক ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল, খামের ভেতর হালকা নীল রঙের একটা চিঠি, উপরে সরকারি সিল, স্মারক নম্বর, হলোগ্রাফিক চিহ্ন, নিচে গোটা গোটা টাইপে লেখা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি। রুরাক দুই একটা অক্ষরের বেশি পড়তে পারে না তারপরও সে চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়ল। সুহান চিঠিটা পড়ে মাথা নাড়ল, বলল, । আসলেই আমি চাকরি পেয়েছি।
রুরাক বিস্ময়াভিভূতভাবে সুহানের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তার মানে তোমার একটা ভিডিফোন হবে, গাড়ি হবে?
সুহান হেসে ফেলল। একটা বড় ডাটাবেস অফিসে সিকিউরিটির চাকরি, যে বেতনের কথা লিখেছে সেটা দিয়ে ভালো করে খেতে-পরতে পারবে কিনা সেটাই সন্দেহ! কিন্তু রুরাককে এসব বলে লাভ নেই, তার অপরিণত মস্তিষ্কের জন্য সেটা খুব বেশি হয়ে যাবে,
সে বলল, একদিনে তো হবে না। আস্তে আস্তে হবে।
রুস্রাক উত্তেজিত গলায় বলল, তোমার যখন ভিডিফোন হবে তখন আমাকে সেটা দিয়ে কথা বলতে দেবে?।
সুহান হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, কার সাথে কথা বলবে?
রুরাক বলল, এখন বলব না।
আমি জানি তুমি কার সাথে কথা বলবে।