আমি সায়রার দিকে তাকিয়ে বললাম কার সাথে কথা বলছেন?
সায়রা মনে হল আমার প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে চাইছিল না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতস্তত করে বলল, জরিনির সাথে।
জরিনি? জরিনি কে?
ইঁদুর। ঐ যে দেখেন
আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি একটি ছোট খাঁচা এবং সেখানে একটা ছোট নেংটি ইঁদুর ঠিক মানুষের মতো দুই হাত বুকে ভাজ করে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কানে দুল এবং গলায় মালা। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হল ইঁদুরটার মুখে ফিচলে এক ধরনের হাসি। আমি অবাক হয়ে জরিনির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই ইঁদুরটা হাসছিল? ইঁদুর মানুষের মতো হাসতে পারে?
পারে না। জরিনি মাথা নাড়ল, ইঁদুরের ভোকাল কর্ড ছোট, শব্দ বের হয় অন্যরকম।
কিন্তু আমি যে হাসতে শুনলাম?
হাসির শব্দ টেপ করা আছে। যখন হাসার ইচ্ছে করে তখন সুইচ টিপে দেয়। বেটি মহা ফাজিল হয়েছে। যখনই আমার কিছু একটা গোলমাল হয় তখন ফ্যাকফ্যাক করে হাসে।
আমি অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকালাম, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে মেয়েটার হয়তো একটু মাথা খারাপ। সায়রা আমার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
আমি বললাম, মানুষ একটা জিনিস বিশ্বাস করে কিংবা অবিশ্বাস করে কথাটা বোঝার পর। আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
সায়রা মাথা নাড়ল, বলল, বোঝার কথা না!
একটু বুঝিয়ে দেন।
সায়রা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আবার কাউকে বলে দেবেন না তো?
আপনি না করলে বলব না। কিন্তু মানুষকে বলার জন্য এর চাইতে মজার গল্প আর কী হতে পারে?
যত মজারই হোক আপনি কাউকে বলবেন না।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ঠিক আছে বলব না।
সায়রা ইঁদুরটার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে ইঁদুরটা দেখছেন, এটার আই কিউ একশ বিশের কাছাকাছি। যার অর্থ এর বুদ্ধি আমাদের দেশের মন্ত্রীদের থেকে বেশি। আপনি বলতে পারেন সেটা খুব বেশি না-কিন্তু একটা ইঁদুরের জন্য সেটা অনেক। এটা অনেক শব্দ বুঝতে পারে কথা বলতে পারে না কিন্তু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে মোটামুটি বুঝিয়ে দিতে পারে। আমি মোটামুটি কিছু শব্দ তৈরি করে মাইক্রো সুইচে সাজিয়ে দেব বলে ঠিক করেছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হবে না।
কেন?
ছেমড়ি মহা ফাজিল। খাবার দিতে একটু দেরি হলেই ধমকাধমকি শুরু করে দেয়!
আমি ঢোক গিলে বললাম, তাজ্জবের ব্যাপার। কোথায় পেলেন এই চিজ?
সায়রা আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, পাব আবার কোথায়? আমি তৈরি করেছি।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম তৈরি করেছেন? ইঁদুর তৈরি করা যায়?
ইঁদুর তৈরি করি নি। ইঁদুর তো ইঁদুরই-সেটা আবার তৈরি করে কেমন করে! এর বুদ্ধিটা তৈরি করেছি।
আমি মাথা চুলকে বললাম, কেমন করে তৈরি করলেন?
সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস। সায়রা সেই ইতিহাসের সমান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বলতে পারেন, এটা হচ্ছে দ্রুত এবং নিয়ন্ত্রিত বিবর্তন। বিবর্তন কী জানেন তো?
আমি মাথা চুলকে বললাম, একটু একটু জানি।
একটু জানলেই হবে। পৃথিবীর যত প্রাণী আছে, যত জীবজন্তু আছে সবার মিউটেশন হয়। নানা কারণে সেই মিউটেশন হতে পারে-রেডিয়েশন, এনভায়রনমেন্ট বা অন্যান্য ব্যাপার। সেই মিউটেশনের কারণে কোনো কোনো প্রাণী হয় ভালো-কোনো কোনোটা হয় খারাপ। যেটা খারাপ হয় সেটা টিকে থাকতে পারে না-যেটা ভালো সেটা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে পারে। এভাবে বিবর্তন এগিয়ে যায়-ধীরে ধীরে জীবজন্তু পরিবর্তন হয়। সেটা হতে লক্ষ বছর লেগে যায়।
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি এই বিবর্তনের ব্যাপারটার মাঝে দুটো জিনিস করেছি। এক : মিউটেশনের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে হালকা ডোজ রেডিয়েশন দেওয়া শুরু করেছি এবং দুই : বেছে বেছে যারা সুপিরিয়র তাদের রিপ্রোডিউস করেছি। রেডিয়েশনের জন্য একটা খুব হালকা সিজিয়াম ওয়ান থার্টি এইট সোর্স ব্যবহার করেছি। সায়রা থেমে গিয়ে বলল, কাউকে বলে দেবেন না যেন!
আমি বললাম, সেটা নিয়ে আপনি চিন্তা প্রবেন না-কী বলছেন সেটার মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝি নি। সিজি আম আর ফজলি আমের মাঝে কী পার্থক্য সেটাও আমি জানি না।
সায়রা বিজ্ঞানীদের খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে বিরক্ত হয়ে বলল, এটা কোনো আম না। এটা হচ্ছে এক ধরনের এলিমেন্ট। সিজিয়াম। আর সিজিয়াম ওয়ান পার্টি এইট হচ্ছে রেডিও একটিভ এলিমেন্ট। যাই হোক যেটা বলছিলাম, রেডিয়েশন দিয়ে মিউটেশন করে আমি অনেকগুলো ইঁদুরের বাচ্চা দিয়ে কাজ শুরু করলাম। সবগুলোকে একটা খাঁচায় রেখে তাদের একটা বুদ্ধির পরীক্ষার মাঝে ফেলে দিলাম। যে ইঁদুর একটা ছোট বলকে ঠেলে একটা গোল গর্তের মাঝে ফেলতে পারবে সে ভালো খাবার পাবে। বেশিরভাগই বুদ্ধির পরীক্ষায় ফেল করল-যারা পাস করল তাদের নিয়ে ইঁদুরের সংসার শুরু হল। আবার লো ডোজ রেডিয়েশন, আবার বাচ্চাকাচ্চা এবং বাচ্চাকাচ্চার ওপর আবার নতুন করে বুদ্ধির পরীক্ষা, এবার পরীক্ষা আগের থেকেও কঠিন। ছোট একটা ত্রিভুজকে তিনকোনা একটা গর্তে ফেলতে হবে আর ছোট একটা চতুর্ভুজকে চারকোনা একটি গর্তে ফেলতে হবে।
সায়রা নিশ্বাস নেবার জন্য একটু থামতেই আমি বললাম, ইঁদুরে ত্রিভুজ চতুর্ভুজ বুঝতে পারে? আমিই তো পারি না।