কী জিনিস?
আপার সাথে কুনু দুই নম্বুরি কাজ করার চেষ্টা করবেন না। করলে কিন্তু মানুষটা হাত দিয়ে গলায় পোঁচ দেবার মতো ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিল আপা আমাকে খুন করে ফেলবে।
আমি বললাম, না, করব না। কোন এক নম্বুরি কাজ করারই সাহস পাই না, দুই নম্বুরি কাজ করব কেমন করে-তাও সাধারণ একজন মানুষের সাথে না, খ্যাপা একজন বিজ্ঞানীর সাথে? যে শুধু বিজ্ঞানী না, মহিলা বিজ্ঞানী এবং যে যন্ত্রে টিপ দিয়ে কালা ছগীরকে পর্যন্ত কাবু করে ফেলে!
এবারে বাসাটা খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল টিপে দিলাম, মনে হল ভেতরে কোথাও একটা বিচিত্র শব্দ হল। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, চাপা একটা ভুটভট শব্দ হচ্ছে, কিসের শব্দ বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করে একটা বিকট শব্দ হল এবং সাথে সাথে একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম, মনে হল রেগে গিয়ে কাউকে বকাবকি করছে। আমি ইতস্তত করে আবার বেলে চাপ দিতেই খুট করে দরজা খুলে গেল, কালিঝুলি মাখা একটি মাথা উঁকি দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
মগবাজারের মোড়ের সেই মেয়েটিই, তবে তাকে দেখতে এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। সেদিন শাড়ি পরেছিল, আজকে পুরুষ মানুষের মতো একটা ওভারওল পরেছে। তার অনেকগুলো পকেট আর সেই পকেট থেকে নানা সাইজের ক্রু ড্রাইভার, প্লয়ার্স, রুলার, পেন্সিল, ফ্ল্যাশলাইট, সন্ডারিং আয়রন এইসব বের হয়ে আছে। কোমরে বেল্ট, সেই বেন্ট থেকে একটা বড় হাতুড়ি ঝুলছে। মেয়েটির মাথায় টকটকে লাল রঙের একটা রুমাল বাধা, শুধুমাত্র সেটা থাকার কারণেই তাকে দেখতে একটা মেয়ের মতো লাগছে, ঠিক করে বললে বলতে হয় একটা জিপসি মেয়ের মতো। আমি মেয়েটির কালিঝুলি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি মানে ইয়ে-ঐ যে সেদিন মগবাজারে
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, চিনেছি–আসেন, ভেতরে আসেন। আমি তখনই বুঝেছিলাম আপনি আসবেন।
কেমন করে বুঝেছিলেন?
আপনার চোখ দেখে। আপনার চোখে ছিল অবিশ্বাস। আপনি ভেবেছিলেন আমি মিথ্যে কথা বলছি। তাই আপনি নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন। ঠিক বলেছি কি না?
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম না-না-না। আপনি একেবারেই ঠিক বলেন নি। আমি আপনাকে কখনোই অবিশ্বাস করি নি। আসলে ইয়ে মানে সত্যি কথা বলতে কি-
ঠিক তখন ভিতরে আবার ভুশ করে একটা শব্দ হল এবং আমার মনে হল সারা ঘরে ডালে ফোড়ন দেওয়ার মতো একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। সায়রা মাথা নেড়ে কেমন যেন হতাশ হবার ভঙ্গি করে পা দিয়ে মেঝেতে একটা লাথি দিল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কী হয়েছে?
আমার যন্ত্রটার সেফটি ভাল্ব কাজ করছে না, একটু প্রেসার বিল্ড আপ করলেই লিক করছে। গন্ধ পাচ্ছেন না?
আমি মাথা নাড়লাম, ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু গন্ধটা তো কেমন যেন ডালে ফোড়ন দেওয়ার মতো-
হ্যাঁ, এটা ডাল রান্না করার মেশিন।
ডাল রান্না করার মেশিন? আমি অবাক হয়ে বললাম, ডাল রান্না করতে মেশিন লাগে?
ব্যবহার করলেই লাগে। সায়রা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে লেকচার শুরু করে দেন-মেয়েরা কিছু পারে না, তাদের চিন্তাভাবনা রান্নাঘরের বাইরে যেতে পারে না-হ্যাঁনো তেনো
আমি হাত নেড়ে বললাম, না না, এটা আপনি কী বলছেন! আমি সেটা কেন বলব? তবে_
তবে কী?
এত জিনিস থাকতে আপনার ডাল রাঁধার মেশিন তৈরি করার আইডিয়া কেমন করে হল?
সেটা আপনারা বুঝবেন না।
চেষ্টা করে দেখেন, বুঝতেও তো পারি।
আপনারা-পুরুষ মানুষেরা মেয়েদেরকে রান্নাঘরে আটকে রাখতে চান। ভাত রাঁধ, ডাল রাধ, মাছ মাংস সবজি রাঁধ-আপনাদের ধারণা রান্নাবান্না করাই আমাদের একমাত্র কাজ। সেজন্য আমি রান্না করার মেশিন তৈরি করছি।
রান্না করার মেশিন?
হ্যাঁ। ডাল দিয়ে শুরু করেছি। আস্তে আস্তে সবকিছু হবে। সকালে উঠে সুইচ টিপে দেবেন, দুপুর বেলা সবকিছু রান্না হয়ে যাবে। ভাত ডাল মাছ মাংস। মেয়েদের তখন। রান্নাঘরে আটকা থাকতে হবে না।
আমি মাথা চুলকালাম, যুক্তিটার মাঝে কিছু গোলমাল আছে মনে হল কিন্তু এখন সেটা নিয়ে কথা বলা মনে হয় ঠিক হবে না। আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি আসলে এসেছিলাম
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, কী বলছিলেন যেন?
আসলে ইন্টারেস্টিং মানুষ দেখতে, তাদের সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ হচ্ছে বোরিং। খায়-দায়, চাকরি করে আর ঘুমায়।
আমি ইন্টারেস্টিং?
অবিশ্যি। ডাল রান্না করার মেশিন আবিষ্কার করছে সেরকম মানুষ বাংলাদেশে কতজন আছে?
সায়রা মুখটা গম্ভীর করে বলল, আমি ভেবেছিলাম কাজটা সহজ হবে। কিন্তু আসলে মহা কঠিন। টেম্পারেচার ঠিক হওয়ার আগে যদি ডাল ঢেলে দেওয়া হয়- কথা শেষ হবার আগেই আবার ভুশ করে একটা শব্দ হল এবং এবারে সাথে সাথে সারা ঘরে একটা পোড়া ডালের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। সায়রা মাথা নেড়ে বলল, একটু দাঁড়ান। মেশিনটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।
আমি আসি আপনার সাথে?
আসবেন? আসেন।
আমি সায়রার পিছু পিছু গেলাম, বড় একটা ঘরের মাঝামাঝি বিশাল একটা যন্ত্র। নানারকম পাইপ বের হয়ে আছে। মাঝখানে নানারকম আলো জ্বলছে এবং নিবছে। স্বচ্ছ একটা জায়গায় হলুদ রঙের কিছু একটা ভুটভাট করে ফুটছে। একপাশে একটা টিউব দিয়ে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু একটা বের হচ্ছে। সায়রা কোথায় টিপে ধরতেই নানা রকম শব্দ করে যন্ত্রটা থেমে গেল এবং ঘরের মাঝে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে এল। ঠিক তখন মনে হল কে যেন খিকখিক করে হাসছে। সায়রা পিছনে ফিরে ধমক দিয়ে বলল, খবরদার হাসবি না এরকম করে। সাথে সাথে হাসির শব্দ থেমে গেল। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম, কেউ নেই ঘরে, কার সাথে বলছে মেয়েটি?