বিল্টু কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে একবার কার্ডটার দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, কী হল? কিছু বলছিস না কেন?
বিল্টু তবুও কথার উত্তর না দিয়ে কম্পিউটারে খুটখাট করতে থাকে এই যন্ত্রটা মনে হয় আসলেই শয়তানের বাক্স। বিল্টু ছেলেটা দুষ্টু এবং পাজি ছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে দুষ্ট, পাজি এবং বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আমি তার মেজো মামা-তাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, সে সেই কথাটার উত্তর পর্যন্ত দিচ্ছে না। কানে ধরে একটা রদ্দা দিলে মনে হয় সিধে হয়ে যাবে। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েদের কানে ধরে রদ্দা দেওয়া যায় না। আমি নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, কী হল? কথা কানে যায় না? একটা জিনিস জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দিবি না?
বিল্টু তার কম্পিউটারে খুটখাট বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, তুমি যে জিনিসটা জিজ্ঞেস করেছ তার উত্তর দিলে তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না?
বিল্টু মাথা নাড়ল, না। তুমি কিছু জান না, বোঝ না-শুধু ভান কর যে সবকিছু জান আর বোঝ।
আমি রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, বিল্টু তার সুযোগ দিল না, বলল, তোমার কার্ডে যেটা লেখা আছে সেটা হচ্ছে একটা ইন্টারনেট ওয়েবসাইটের ইউ. আর. এল। তুমি কিছু বুঝলে?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না, মানে ইয়ে
তার মানে তুমি বোঝ নাই।
তাই বলে তুই বলবি না?
আমি ভাবছিলাম তোমাকে দেখিয়ে দিই।
কীভাবে দেখাবি?
সেটাও তুমি বুঝবে না। তার চাইতে তুমি মেজাজ গরম না করে দাঁড়িয়ে থাক- এক্ষুনি কম্পিউটারে এসে যাবে।
ক-কম্পিউটারে এসে যাবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথা থেকে আসবে? কেমন করে আসবে?
বিল্টু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, তুমি বুঝবে না মামা, শুধু শুধু চেষ্টা করে লাভ নাই।
কম্পিউটারে হঠাৎ করে কিছু ছবি চলে এল আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটি ছবি হচ্ছে সেই খ্যাপা মেয়েটির, বিদঘুটে একটা যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, এখানে কোথা থেকে এল এই মেয়ে? কী আশ্চর্য!
বিল্টু গম্ভীর হয়ে বলল, মামা তুমি পরে আশ্চর্য হয়ো। এখন যেটা দেখার দেখে নাও। গত মাসে আমার ইন্টারনেট বিল কত হয়েছিল জান?
ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিলের কথা শুনেছি কিন্তু ইন্টারনেট বিল আবার কী জিনিস? কম্পিউটারে আরো ছবি আর লেখা বের হতে থাকে। কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ব বুঝতে পারছি না। বিল্টু বলল, তাড়াতাড়ি মামা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি করাবি না তো? আমি তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারি না।
সেটা আমি জানি। তুমি হচ্ছ আমাদের ঢিলেঢালা মামা।
ফাজলেমি করবি না।
তার চাইতে বলো তুমি কী চাও আমি বের করে দিই।
আমি বিদঘুটে যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখছিস মেয়েটা এই মেয়ে হচ্ছে একজন খ্যাপা সায়েন্টিস এই মেয়ের নাম ঠিকানা টেলিফোন নাম্বারটা দরকার।
সেটা আগে বলবে তো! বিল্টু তার কম্পিউটারে খুটখাট করতে করতে বলল, তুমি হচ্ছ পুরান মডেলের মানুষ-সেই জন্য তোমার নাম-ঠিকানা দরকার! আজকাল মানুষ আর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে না।
তা হলে কী ব্যবহার করে?
ই-মেইল।
আমি হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, আমার ই-মেইল উ-মেইলের দরকার নেই- আমার দরকার নাম-ঠিকানা।
ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে– বলে বিল্টু একটা কাগজে কিছু একটা লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই যে তোমার নাম-ঠিকানা। তুমি এখন বিদায় হও মামা। তুমি বড় ডিস্টার্ব কর।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মামাদের পিছনে ঘোরাঘুরি করতাম। তারা মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে বলতেন, ভাগ এখান থেকে, ডিস্টার্ব করবি না। এখন আমার ভাগ্নে আমাকে বলে তাকে ডিস্টার্ব না করতে! আস্তে আস্তে দুনিয়াটা কী হয়ে যাচ্ছে?
.
বাসাটা খুঁজে বের করতে আমার কালো ঘাম ছুটে গেল, যারা বাসার নম্বর দেয় তারা নিশ্চয়ই গুনতে জানে না। গুনতে জানলে কি কখনো বাহাত্তরের পর ছেচল্লিশ তারপর ঊনআশি হতে পারে? বাসাটা কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম কোনো লাভ হবে না কিন্তু দেখলাম কমবয়সি দোকানদার একবারেই চিনে ফেলল, চোখ বড় বড় করে বলল, ও সায়রা সাইন্টিস্টের বাসা?
আমি অবাক হয়ে বললাম, সায়রা সায়েন্টিস্ট?
ও! আপনি জানেন না বুঝি? মানুষটা তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, আপা হচ্ছেন ওস্তাদ মানুষ। কালা ছগীরকে একদিন কী টাইট না দিলেন!
টাইট?
জে। মানুষটা উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করল, আপার এই রকম একটা যন্ত্র আছে, দেখে মনে হয় মোবাইল টেলিফোন। সেই যন্ত্রে টিপি দিলেই ইলেকটিরিক বের হয়। কালা ছগীর বুঝে নাই, নেশা করবে টাকা নাই, আপার ব্যাগে ধরে দিছে টান।
তারপর?
আপা বলছে খামোস! তারপর যন্ত্রে দিছে টিপি। ইলেকটিরিক দিয়ে কালা ছগীরের জান শেষ। খালি কাটা মুরগির মতো তড়পায়- দৃশ্যটা চিন্তা করে মানুষটা আনন্দে হাসতে থাকে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সেই আপার বাসাটা কোথায়?
সোজা চলে যান, তিন বাসা পরে হাতের ডানদিকে দোতলা বাসা, সবুজ রঙের গেইট। মানুষটা একটা চোখ ছোট করে বলল, তয় একটা জিনিস সাবধান।