.
প্রেস কনফারেন্সের সময় দেওয়া ছিল বিকেল চারটা, আমি তিনটার সময় হাজির হয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আমি আসার আগেই আরো অনেকে চলে এসেছে। গজনফর আলী আমাকে চিনে ফেলতে পারে বলে আমি একটু পিছনের দিকে বসলাম। আমার পাশের চেয়ারটি সায়রার জন্য বাঁচিয়ে রাখলাম।
স্টেজটি একটু সাজানো হয়েছে, পেছনে একটা বড় ব্যানার, সেখানে লেখা-
বিজ্ঞানী মোল্লা গজনফর আলীর যুগান্তকারী আবিষ্কার
সামনে একটা টেবিল, সেই টেবিলে সায়রার তৈরি করা ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর যন্ত্রটি। পাশে গদি আঁটা একটি চেয়ার। সেই চেয়ারের উপর হেলমেটটি সাজানো। গজনফর আলী বলেছিলেন তিনি নাকি এগুলোকে আবর্জনা হিসেবে ফেলে দিয়েছিলেন।
সায়রা এল ঠিক সাড়ে তিনটার সময়।
আমি ভেবেছিলাম হাতে যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ব্যাগ থাকবে, কিন্তু সেরকম কিছু নেই। কীভাবে সে গজনফর আলীকে শায়েস্তা করবে বুঝতে পারলাম না। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
কীসের কী হল?।
আপনার যন্ত্রপাতি কই?
কীসের যন্ত্রপাতি?
গজনফর আলীকে শায়েস্তা করার জন্য?
সায়রা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমার তাকে শায়েস্তা করতে হবে কে বলেছে?
তা হলে কে শায়েস্তা করবে?
নিজেই নিজেকে শায়েস্তা করবে!
মেয়েটা ঠাট্টা করছে কি না আমি বুঝতে পারলাম না। আমি একটু ভয় নিয়ে সায়রার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ঠিক চারটার সময় মোল্লা গজনফর আলী এসে হাজির হলেন। আজকে চকচকে একটা চকোলেট রঙের সুট পরে এসেছেন। সাথে তার স্ত্রী, এমনভাবে সেজেগুজে এসেছেন যে দেখে মন হয় বারো বছরের খুকি। তারা দুইজন স্টেজে গিয়ে বসলেন। তখন তেইশ চব্বিশ বছরের একটা মেয়ে মাইকের সামনে গিয়ে প্রেস কনফারেন্সের কাজ শুরু করে দিল। সে প্রথমে একটা লিখিত রিপোর্ট পড়ে শোনাল-সেখানে বর্ণনা করা আছে মোল্লা গজনফর আলী জিনিসটা কেমন করে আবিষ্কার করেছেন, সেটি তার কত দীর্ঘদিনের সাধনা, এটা দিয়ে পৃথিবীর কী কী মহৎ কাজ করা হবে ইত্যাদি শুনে আমার সারা শরীর একেবারে তিড়বিড় করে জ্বলতে লাগল।
এরপর গজনফর আলী উঠে দাঁড়ালেন এবং তখন সবার মাঝে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গজনফর আলী মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, উপস্থিত সুধী মহল এবং সাংবাদিকবৃন্দ, আমি নিশ্চিত এতক্ষণে এই রিপোর্টে যা বলা হল আপনারা তার সবকিছু বিশ্বাস করেন নি। আপনাদের জায়গায় থাকলে আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না-এটি কেমন করে সম্ভব, যে অনুভূতিটুকু এতদিন আমরা আমাদের একেবারে নিজস্ব বলে জেনে এসেছি সেটি একটি যন্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? তা হলে মানুষের অস্তিত্বই কি অর্থহীন হয়ে যায় না?
গজনফর আলী উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। আপনারা নিজের চোখে দেখুন, তারপর প্রশ্নের উত্তর বের করে নিন। মোল্লা গজনফর আলী একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, প্রথমে আমার দরকার একজন ভলান্টিয়ার। হাসিখুশি ভলান্টিয়ার, যে মনে করে পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু নেই!
অন্যেরা হাত তোলার আগেই প্রায় তড়াক করে লাফ দিয়ে একটা হাসিখুশি মেয়ে উঠে দাঁড়াল। গজনফর আলী তাকে স্টেজে ডাকলেন। স্টেজে যাবার পর তাকে গদি আঁটা চেয়ারে বসিয়ে মাথায় হেলমেটটা পরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মনের অনুভূতিটি কী?
আনন্দের।
ভেরি গুড। দেখি আপনি আপনার এই আনন্দের অনুভূতিটি ধরে রাখতে পারেন কি।
গজনফর আলী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরের রিমোট কন্ট্রোলের মতো জিনিসের সুইচটা টিপে ধরলেন, দেখতে দেখতে মেয়েটার মুখ একেবারে বিষণ্ণ হয়ে গেল। গজনফর আলী কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনার এখন কেমন লাগছে?
খুব মন খারাপ লাগছে।
কেন?
জানি না। মেয়েটা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
গজনফর আলী বিশ্বজয়ের ভঙ্গি করে সবার দিকে তাকালেন এবং উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করল। গজনফর আলী মাথা নুয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সুইচটা ছেড়ে দিতেই মেয়েটা চোখ মুছে অবাক হয়ে তাকাল। গজনফর আলী তার মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে তার কাছে মাইক্রোফোন নিয়ে বলেন, আপনি কি উপস্থিত সবাইকে আপনার অভিজ্ঞতাটুকু বলবেন?
মেয়েটা উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে বলকী আশ্চর্য! একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমি বুকের মাঝে আনন্দের অনুভূতি নিয়ে বসে আছি, হঠাৎ কী হল একটা গভীর দুঃখ এসে ভর করল। কী গভীর দুঃখ আপনার চিন্তাও করতে পারবেন না। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কাঁদতে শুরু করেছিলাম– আমি জীবনে কখনো কেঁদেছি বলে মনে করতে পারি না। তারপর ম্যাজিকের মতো হঠাৎ করে সেই দুঃখ চলে গেল। একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
যারা সামনে বসেছিল আবার আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। গজনফর আলী হাত তুলে তাদের থামিয়ে বললেন, এবারে আমার আরেকজন ভলান্টিয়ার দরকার, যে বাঘের বাচ্চার। মতো সাহসী। যে কোনো কিছুতে ভয় পায় না।
গাট্টাগোট্টা টাইপের একজন এবারে উঠে দাঁড়াল। গজনফর আলী তাকে স্টেজে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। মাথায় হেলমেটটি পরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি সাহসী?
মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, হ্যাঁ আমি সাহসী।
আমাকে দেখে আপনার কি ভয় লাগছে?
নাহ! কেন ভয় লাগবে?