আমি শেষ পর্যন্ত পড়তে পারলাম না, খবরের কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলাম।
মাসখানেক পর নীলক্ষেত থেকে রিকশা করে আসছি, আর্ট ইনস্টিটিউটের সামনে দেখি মানুষের ভিড়। সুন্দর জামাকাপড় পরা মানুষজন গাড়ি থেকে নামছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি গেটের পাশে ফেস্টুন, বড় বড় করে লেখা–
মোল্লা গজনফর আলীর একক চিত্রপ্রদর্শনী।
আমি রিকশায় বজ্রাহতের মতো বসে রইলাম। রাগে-দুঃখে ঐ এলাকা দিয়েই হাঁটাচলা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তাতে কি আর রক্ষা আছে? একদিন টেলিভিশন দেখছি, হঠাৎ দেখি টেলিভিশনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে এক উপস্থাপিকা মোল্লা গজনফর আলীকে নিয়ে এসেছে। দেখলাম তাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি বিজ্ঞানের প্রফেসর, হঠাৎ করে কবিতা এবং ছবি আঁকায় উৎসাহী হলেন কেন?
মোল্লা গজনফর আলী হাত দিয়ে মাথার এলোমেলো চুলকে সোজা করতে করতে বললেন, আসলে সৃজনশীলতা একটি অনুভবের ব্যাপার। আমার হঠাৎ করে মনে হল, সারা জীবন তো বিজ্ঞানের সেবা করেছি-সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলোয় একটু পদচারণা করে দেখি।
উপস্থাপিকা ন্যাকা ন্যাকা গলার স্বরে ঢং করে বলল, কিন্তু আপনার পদচারণা তো ভীরু পদচারণা নয়, সাহসী পদচারণা, দৃপ্ত পদচারণা-
মোল্লা গজনফর আলী স্মিত হেসে বললেন, প্রতিভার ব্যাপারটি তো আসলে নিয়মকানুন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না-
এই পর্যায়ে আমি লাথি দিয়ে আমার টেলিভিশনটা ফেলে দিলাম, সেটা উল্টে পড়ে ভেতরে কী একটা ঘটে গেল, বিকট একটা শব্দ হল এবং কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল।
.
মোল্লা গজনফর আলী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা সিডি বের করে ফেললেন, তখন ব্যাপারটা আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, সায়রার কাছে গিয়ে নালিশ করলাম।
পুরো ব্যাপারটা শুনে সায়রা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন?
রাগব না? এই বেটা বদমাশ শুধু যে আপনার যন্ত্র চুরি করল তাই নয়, এখন সেটা ব্যবহার করে কবি হয়েছে, আর্টিস্ট হয়েছে এখন গায়ক হচ্ছে?
হলে ক্ষতি কী?
কোনো ক্ষতি নাই?
না।
আমিও তো গজনফর আলীর মতো কবি, শিল্পী আর গায়ক হতে পারতাম–পারতাম না?
সায়রা আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, উঁহু, আপনি পারতেন না। মানুষকে ঠকানোর জন্য যে ফিচলে বুদ্ধি দরকার, আপনার সেটা নাই। আপনি হচ্ছেন সাদাসিধে মানুষ।
কাজেই সায়রাকে কোনোভাবেই কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজি করানো গেল না।
.
যত দিন যেতে লাগল মোল্লা গজনফর আলী ততই বিখ্যাত হতে লাগলেন। ম্যাগাজিনে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হতে লাগল, বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার পেতে লাগলেন। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল, যখন দেখলাম, মোল্লা গজনফর আলী প্রধান অতিথি হয়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পুরস্কার দিচ্ছে। পুরস্কার দিয়ে তাদেরকে সুনাগরিক হয়ে দেশ এবং সমাজের সেবা করার উপদেশ দিচ্ছে। আমার জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গেল। মনে হতে লাগল, মোল্লা গজনফর আলীকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলে যাই। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না। ব্যাটা বদমাশ তখন শহীদ হয়ে যাবে তার নামে স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়ে যাবে!
মোল্লা গজনফর আলীর উৎপাতে যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কথা চিন্তাভাবনা করছি তখন হঠাৎ করে পত্রিকায় একটা খবর ছাপা হল যেটা দেখে আমার পুরো চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। খবরটি এরকম, উপরে হেডলাইন
বাঙালি বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কার
মানুষের অনুভূতি এখন হাতের মুঠোয়
তার নিচে ছোট ছোট করে লেখা–
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী যিনি একাধারে কবি, শিল্পী এবং গায়ক হিসেবে এই দেশের সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অঙ্গনে সুপরিচিত, তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা জাতির। সামনে প্রকাশ করছেন। প্রফেসর মোল্লা গজনফর আলী। জানিয়েছেন, মানুষের মস্তিষ্কে উচ্চ কম্পনের চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে তাদের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছেন। আগামী মঙ্গলবার স্থানীয় প্রেসক্লাবে তিনি তার আবিষ্কারটি জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন।
পাশেই একটি রঙিন ছবি, মোল্লা গজনফর আলী রিমোট কন্ট্রোলের মতো দেখতে কন্ট্রোলটি হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে তার স্ত্রী হেলমেটটি মাথায় দিয়ে বসে আছে। দুইজনের মুখেই স্মিত হাসি। নিচে মোল্লা গজনফর আলীর জীবনবৃত্তান্ত।
খবরটি দেখে আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমি তখন তখনই কাগজটা হাতে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে সায়রার বাসায় হাজির হলাম। আমাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সায়রা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আমি কাগজটা তার হাতে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, এই দেখেন!
সায়রা ছবিটা দেখল এবং খবরটা পড়ল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলল। প্রত্যেকবার সে যেরকম পুরো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, এবারে সেরকম হেসে উড়িয়ে দিল না, তার মুখটা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেল। আমি বললাম, কী হল?
মানুষটাকে শাস্তি দেওয়ার একটা সময় হয়েছে। কী বলেন?
আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, এক শ বার।
ঠিক আছে। মঙ্গলবার দেখা হবে।
কোথায় দেখা হবে?
প্রেসক্লাবে।
সায়রা কী করবে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু এই মেয়েটার ওপরে আমার বিশ্বাস আছে। আমি মঙ্গলবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম মনে হতে লাগল ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডগুলো এত আস্তে আস্তে আসছে যে মঙ্গলবার বুঝি কোনোদিন আসবেই না!