গজনফর আলী খ্যাকখ্যাক করে হেসে বললেন, করেন গিয়ে, তখন টের পাবেন কত ধানে কত চাল! পুলিশের লোকেরা কাউকে ভয় পায় না, শুধু খবরের কাগজকে ভয় পায়। আমি হচ্ছি সেই খবরের কাগজের লোক। এই টেলিফোন দিয়ে আমি একটা ফোন করব, আর আপনি থানায় যাওয়ামাত্র আপনাকে ক্যাঁক করে অ্যারেস্ট করে হাজতে নিয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে রিমান্ড। রিমান্ড কী জিনিস আপনি জানেন?
এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?
গজনফর আলী মুখে মধুর একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, আপনি মনে হয় খবরের কাগজ পড়েন না, তাই দেশের অবস্থা জানেন না। দেশের অবস্থা এখন মগের মুল্লুক থেকে খারাপ। হে হে হে।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। গজনফর আলী গলার স্বর নরম করে বললেন, আপনাকে একটা উপদেশ দেই। এটা নিয়ে কোনো তেড়িবেড়ি করবেন না, তা হলে অবস্থা খারাপ হবে। প্রথমে আপনাকে নিয়ে আর সেই মহিলা সায়েন্টিস্টকে নিয়ে পত্রিকায় জঘন্য জঘন্য রিপোর্ট বের হবে! তাতেও যদি শান্ত না হন আমার অন্য ব্যবস্থা আছে।
অন্য কী ব্যবস্থা?
গালকাটা বক্করের নাম শুনেছেন?
আমি শুকনো গলায় বললাম, শুনেছি।
সাতাশটা কেস আছে, তার মাঝে বারোটা মার্ডার কেস। পুলিশের বাবার সাধ্য নাই তাকে ধরে। সবার নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে গালকাটা বক্করের?
আমার কথায় ওঠে-বসে। আমার মোবাইলে নম্বর ঢোকানো আছে। খালি একটা মিস কল দিব, ব্যস। গজনফর আলী হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার একটা ভঙ্গি করলেন। আমি অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
সায়রা যখন শুনবে তার এই ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর প্রফেসর গজনফর আলী চুরি করে রেখে দিয়েছে-তখন কী করবে সেটা চিন্তা করে আমার পেটের ভাত একেবারে চাল হয়ে গেল। খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি তাকে খবরটা দিতে গেলাম। কিন্তু সায়রা দেখলাম ব্যাপারটার কোনো গুরুত্বই দিল না। গজনফর আলীর পাহাড়ের মতো স্ত্রী গজু বলে মধুর গলায় ডাকছিল সেই অংশটা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আপনি হাসছেন? দিনদুপুরে এরকম ডাকাতি করল আর আপনি সেটা শুনে হাসছেন?
ছোট একটা যন্ত্র চুরি করে রেখেছে, রাখতে দিন! বউয়ের ভালবাসার জন্য করেছে- আহা বেচারা!
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, কাকে আপনি বেচারা বলছেন? গজনফর আলী কত বড় বদমাশ আপনি জানেন? এই লোকের এক শ বছর জেল হওয়া উচিত!
সায়রা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, সোসাইটিতে সবাই যদি একরকম হয় তা হলে লাইফটা বোরিং হয়ে যাবে। এই জন্য কাউকে হতে হয় ভালো, কাউকে খারাপ আর কাউকে হতে হয় গজনফর আলীর মতো বদমাশ!
আমি অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকিয়ে রইলাম, সায়রা যদি বিজ্ঞানীর সাথে সাথে দার্শনিক হতে শুরু করে তা হলে তো মহাবিপদ হয়ে যাবে। আমি বললাম, কিন্তু আপনার এত মূল্যবান একটা যন্ত্র
কে বলেছে মূল্যবান! কয়টা কয়েল, একটা পুরোনো পাওয়ার সাপ্লাই, একটা সস্তা হেলমেট-সব মিলিয়ে দুই হাজার টাকার জিনিস আছে কি না সন্দেহ!
কিন্তু আপনার পরিশ্রম?
কে বলেছে পরিশ্রম। এসব কাজ করতে ভালো লাগে, কোনো পরিশ্রম হয় না।
তাই বলে ঐ বদমাশ গজনফর আলী এত সুন্দর একটা জিনিস নিয়ে যাবে?
আপনি চিন্তা করবেন না। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর কীভাবে তৈরি করতে হয় আমি জানি। দরকার হলে আমি ডজন ডজন তৈরি করে দেব।
কিন্তু একটা মানুষ এত বড় অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে? কোনো শাস্তি পাবে না?
অন্যায়? শাস্তি? হঠাৎ করে সায়রা অন্যমনস্ক হয়ে কী একটা ভাবতে লাগল। আমি সায়রার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আমাকে দেখছে না! গভীর কোনো একটা চিন্তায় ডুবে গেছে।
বিজ্ঞানীরা যখন গভীর চিন্তায় ডুবে যায় তখন তাদের ঘটানো ঠিক না, তাই তাকে বিরক্ত না করে আমি চলে এলাম।
.
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা, দৈনিক মোমের আলো পত্রিকার সাহিত্যপাতায় দেখি একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতার নাম তোমাকে স্পর্শ করি এবং কবিতাটি লিখেছেন মোল্লা গজনফর আলী। দেখে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম–মোল্লা গজনফর আলীর মতো মানুষ কবিতা লিখে ফেলেছে? সেই কবিতা আবার ছাপাও হয়েছে? আমি কবিতাটি পড়ার চেষ্টা করলাম, শুরু হয়েছে এভাবে
বুকের ভেতর খেলা করে আমার সকল বোধ
তোমাকে স্পর্শ করি–
কবিতাটি পড়ে আমার কোনো সন্দেহই থাকল না যে আসলে এই বদমাশ মানুষটা সায়রার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে কবিতাটা লিখে ফেলেছে। রাগে আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। কিছু করার চেষ্টা করলে মোল্লা গজনফর আলী নিশ্চয়ই গালকাটা বক্করকে কাটা রাইফেল দিয়ে আমার বাসায় পাঠিয়ে দেবে।
ব্যাপারটা আমার একেবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল যখন দেখলাম বইমেলায় মোল্লা গজনফর আলীর একটা কবিতার বই বের হয়েছে, বইয়ের নাম অনুভূতির চেনা বাতাস। শুধু যে বের হয়েছে তা নয়, বই নাকি একেবারে মার মার কাট কাট করে। বিক্রি হচ্ছে। দৈনিক মোমের আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ছবি বের হল–মোল্লা গজনফর আলী পাঞ্জাবি পরে বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন আর তার চারপাশে কমবয়সি মেয়েরা ভিড় করে। আছে।
বইমেলার শেষের দিকে বিশেষ বই নিয়ে আলোচনা বের হল, সেখানে অনুভূতির চেনা বাতাস বইয়ের ওপর বিশাল-আলোচনা। লেখা হয়েছে, আমাদের কাব্য অঙ্গনের স্থবিরতা দূর করতে যে মানুষটি প্রায় হঠাৎ করে উপস্থিত হয়েছেন তার নাম মোল্লা গজনফর আলী। কবিতার জগতে তার পদচারণা ফারুনের ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী এবং বিক্ষুব্ধ…