আমি রিমোট কন্ট্রোলের মতো যন্ত্রটা দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখেন, এখানে সব লেখা আছে। হাসি কান্না ভালবাসা থেকে শুরু করে রাগ দুঃখ ভয় সবকিছু। আমি তারপর গজনফর আলীকে সাবধান করে দিয়ে বললাম রাগ দুঃখ ভয় এইসব অনুভূতি থেকে খুব সাবধানে থাকতে বিপদ হয়ে যেতে পারে। গজনফর আলী খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে বললেন, এটা কেমন করে চালায়?
আমি গজনফর আলীকে ট্রান্সক্রেনিয়াল ষ্টিমুলেটর চালানোটা শিখিয়ে দিলাম। গজনফর আলীর চোখ কেমন জানি চকচক করতে লাগল, একটা নিশ্বাস আটকে রেখে বললেন, ঠিক আছে জাফর ইকবাল সাহেব, আপনার যন্ত্রটা আপনি আজকে রেখে যান, আমি দেখি। কালকে আপনি একবার আসেন, তখন ঠিক করা যাবে এটা নিয়ে কী ধরনের রিপোর্ট লেখা যায়।
সায়রা সায়েন্টিস্টের তৈরি এই যন্ত্রটা আমার একেবারেই রেখে যাওয়ার ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমি না করতে পারলাম না। এই মানুষটা না বলা পর্যন্ত দৈনিক মোমের আলো পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হবে না-আমার ছবি ছাপা হবে না, কাজেই কিছু করার নেই। তবে মোল্লা গজনফর আলী আজকে একেবারে নিজের চোখে এটার কাজ দেখেছেন, কাজেই ভালো একটা রিপোর্ট না লিখে যাবেন কোথায়?
.
পরের দিন অফিস থেকে একেবারে সোজা গজনফর আলীর বাসায় চলে গেলাম। আজকে আর ভেতরে হইচই হচ্ছে না, আমি তাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কলিংবেল টিপলাম। বেশ কয়েকবার টেপার পর গজনফর আলী দরজা খুললেন। আমাকে দেখে কেমন যেন ভঙ্গি করে বললেন, কাকে চান?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন না? গতকাল ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর নিয়ে এসেছিলাম!
ও! ও! হঠাৎ মনে পড়েছে সেরকম ভান করে বললেন, ঐ যে খেলনাটা নিয়ে এলেন!
খেলনা? আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম, খেলনা কী বলছেন? যুগান্তকারী আবিষ্কার।
গজনফর আলী মুখ বাঁকা করে হেসে বললেন, আপনাদের নিয়ে এই হচ্ছে সমস্যা। কোনটা আবিষ্কার আর কোনটা খেলনা তার পার্থক্য ধরতে পারেন না।
কী বলছেন আপনি? আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার স্ত্রীর মাথায় লাগিয়ে পরীক্ষা করলাম আমরা, মনে নাই? আপনাকে ভালবেসে গজু বলে ডাকলেন-।
গজনফর আলী হাত নেড়ে বললেন, ঠাট্টা সব ঠাট্টা। আমার স্ত্রী খুব রসিক, সে ঠাট্টা করছিল, আমাকে বলেছে।
অসম্ভব! আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, হতেই পারে না।
গজনফর আলী চোখ পাকিয়ে বললেন, আপনি আমার বাসায় এসে আমার ওপর গলাবাজি করছেন, আপনার সাহস তো কম নয়।
আমি গলা আরো উঁচু করে বললাম, আপনি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলবেন আর আমি সেটা সহ্য করব? (স।
গজনফর আলী ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আপনি চলে যাবার পর আপনার ঐ খেলনাটা আমি এক ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করেছি। কোনো কাজ করে না। মাঝে মাঝে হালকা টুংটাং শব্দ শোনা যায়। উল্টো হেলমেটের সাইডে ধারালো একটা জিনিসে ঘষা লেগে আমার গাল কেটে গেছে। এই দেখেন…। গজনফর আলী তার গালে একটা কাটা দাগ দেখালেন।
আমি বললাম, মিথ্যা কথা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শেভ করতে গিয়ে কেটেছে।
শেভ কীভাবে করতে হয় আমি জানি। আপনার জন্মের আগে থেকে আমি শেভ করি। গজনফর আলী চোখ পাকিয়ে বললেন, এই পুরো জিনিসটা হচ্ছে একটা ভাঁওতাবাজি। মানুষকে ঠকানোর একটা বুদ্ধি। আপনাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কেস করা উচিত। চার শ বিশ ধারার কেস।
রাগে আমার মাথা গরম হয়ে উঠল, ইচ্ছে করল গজনফর আলীর নাকে ঘুসি মেরে চ্যাপ্টা নাকটা আরো চ্যাপ্টা করে দিই। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ভাওতাবাজি কে করছে আমি খুব ভালো করে জানি।
জানলে তো ভালোই। গজনফর আলী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমার অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছেন।
ঠিক আছে আর সময় নষ্ট করব না। আমি যাচ্ছি। আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরটা দেন।
গজনফর আলী হাত নেড়ে বললেন, আপনার ঐ যন্ত্র নিয়ে আমি বসে আছি নাকি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
আমার বাসায় আপনাদের সব জঞ্জাল ফেলে রাখবেন আর আমি সেটা সহ্য করব?
গজনফর আলী কী বলছেন আমি তখনো বুঝতে পারলাম না, অবাক হয়ে বললাম, কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
বলছি যে আপনার ঐ জঞ্জাল আমি ফেলে দিয়েছি।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, রীতিমতো আর্তনাদ করে বললাম, ফেলে দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, কোথায় ফেলে দিয়েছেন?
বাসার সামনে ময়লা ফেলার জায়গায়।
আমি রাগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে বললাম, আপনি আমাদের জিনিস ফেলে দিলেন মানে?
আপনাদের জিনিস কে বলেছে? আপনি গতকাল আমাকে দিয়ে গেলেন না?
দেখতে দিয়েছি। ফেলে দিতে তো দেই নি।
গজনফর আলী চোখ ছোট ছোট করে বলল, আপনি কী জন্য দিয়েছেন সেটা তো আর আমার জানার কথা না। আপনার কাজ আপনি করেছেন, আমার কাজ আমি করেছি। আবর্জনা ফেলে দিয়েছি।
আমি এত খেপে গেলাম যে সেটা আর বলার কথা নয়। এই লোকটা-যে নাকি ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর, যে এরকম চোখের ওপর ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলতে পারে আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। সায়রার এই সাংঘাতিক আবিষ্কারটা সে চুরি করেছে। চুরি না বলে বলা উচিত ডাকাতি। একেবারে দিনদুপুরে ডাকাতি। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বললাম, আপনার নামে আমি কেস করব। থানায় জিডি করব।