আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আসলে চোখের যেরকম পাতি আছে কানের তো সেটা নেই। তাই চোখের পাতি ফেলে দেখা বন্ধ করে ফেলা যায়, কিন্তু শোনা তো বন্ধ করা যায় না
তাই বলে আপনি
আমি বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু এই যন্ত্রটা ব্যবহার করে দেখেন আপনাদের ঝগড়াঝাটি বন্ধ হয়ে যাবে।
গজনফর আলীর স্ত্রী চোখ ছোট ছোট করে বললেন, কীভাবে সেটা সম্ভব হবে? তিনি গজনফর আলীকে দেখিয়ে বললেন, এই চামচিকে যে বাসায় থাকে সেই বাসায় কি ঝগড়াঝাটি বন্ধ হতে পারে?
গজনফর আলী হাত নেড়ে বললেন, মুখ সামলে কথা বলল, না হলে কিন্তু খুনোখুনি হয়ে যাবে
কী? তুমি আমাকে খুন করবে? তোমার এত বড় সাহস?
আবার দুজনের মধ্যে একটা হাতাহাতি ব্রু হতে যাচ্ছিল, আমি কোনোমতে থামালাম। বললাম, ঝগড়া না করে এই যন্ত্রটা ব্যবহার করে দেখেন।
গজনফর আলীর স্ত্রী বললেন, কী হবে এই যন্ত্রটা ব্যবহার করলে?
আমি রিমোট কন্ট্রোলের মতো জিনিসটা দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখছেন এখানে লেখা আছে ভালবাসা–এই বোতামটা টিপলেই আপনার হাজব্যান্ডের জন্যে ভালবাসা হবে।
বোতাম টিপলেই?
আগে যন্ত্রটার পাওয়ার অন করে এই হেলমেটটা পরে নিতে হবে।
তা হলেই এই চামচিকার জন্য আমার ভালবাসা হবে?
হ্যাঁ।
তারপরে যে ঘটনাটা ঘটল আমি সেটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে ভদ্রমহিলা হি হি করে হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। হাসতে হাসতে প্রথমে তার চোখে পানি এসে গেল এবং শেষের দিকে তার হেঁককি উঠতে লাগল। কোনোমতে বললেন, এই চামচিৎকার জন্য ভালবাসা? যাকে দেখলেই মনে হয় ছারপোকার মতো টিপে মেরে ফেলি, তার জন্য ভালবাসা? যার চেহারাটা ছুঁচোর মতো, স্বভাবটা চিৎকার মতো তার জন্য ভালবাসা? হি হি হি।
আমি কী করব বুঝতে পারলাম না, বলা যেতে পারে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। গজনফর আলীর স্ত্রী হাসতে হাসতে মনে হয় একসময় ক্লান্ত হয়ে সোফার মাঝে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে! লাগান আমার মাথায়, দেখি এটা কী করে?
গজনফর আলী খুব রাগ রাগ চোখে আমার দিকে আর তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তার মাঝেই ভয়ে ভয়ে যন্ত্রটার সুইচ অন করে হেলমেটটা গজনফর আলীর স্ত্রীর মাথায় পরিয়ে দিলাম। তারপর কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে হালকাভাবে ভালবাসা বোতামটিতে চাপ দিলাম।
এতক্ষণ গজনফর আলীর স্ত্রীর মুখে এক ধরনের তাচ্ছিল্য আর ঘৃণার ভাব ছিল, বোতামটা টিপতেই সেটা সরে গিয়ে তার মুখটা কেমন জানি নরম হয়ে গেল। গজনফর আলীও তার স্ত্রীর নরম মুখটা দেখে কেমন জানি অবাক হয়ে গেলেন।
আমি বোতামটা আরো একটু চাপ দিয়ে মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন আরেকটু বাড়িয়ে দিলাম, সাথে সাথে গজনফরের স্ত্রীর গলা দিয়ে বাঁশির মতো এক ধরনের সুর বের হল, তিনি তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওগো! তুমি ওরকম মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার পাশে এসে বস।
স্ত্রীর গলার স্বর শুনে গজনফর আলী একেবারে হকচকিয়ে গেলেন, কেমন জানি ভয়ের চোখে একবার আমার দিকে আরেকবার তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার স্ত্রীর চোখ কেমন জানি ঢুলুঢুলু হয়ে এসেছে, একরকম মায়া মায়া গলায় বললেন, ওগো! তোমার সাথে আমি কত খারাপ ব্যবহার করেছি। কত নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছি! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও গো!
আমি সুইচ টিপে পাওয়ার আরেকটু বাড়াতেই গজনফর আলীর স্ত্রীর গলা দিয়ে একেবারে মধু ঝরতে লাগল, ওগো গজু। ওগো সোনামণি। ওগো আমার আকাশের চাঁদ আমি কত নিষ্ঠুরের মতন তোমার নাকে ঘুসি মেরেছি। আমার হৃদয়ের টুকরোর ওপর কেমন। করে এই অত্যাচার আমি করতে পারলাম! হাবিয়া দোজখেও তো আমার জায়গা হবে না। আমি কোথায় যাব গো গভু! আমার কী হবে গো গজু!
গজনফরের স্ত্রী এবারে ফ্ল্যাশ ফাঁশ করে কাঁদতে লাগলেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বলো আমাকে ক্ষমা করেছ? বলো গো সোনার টুকরা। চাঁদের খনি। তুমি বলো, তা না। হলে আমি তোমার পায়ে মাথা ঠুকে আত্মঘাতী হব। এই জীবন আমি রাখব না কিছুতেই। রাখব না
গজনফর আলীর স্ত্রী সত্যি সত্যি সোফা থেকে উঠে তার স্বামীর পায়ের ওপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, আমি তাড়াতাড়ি সুইচ থেকে হাত সরিয়ে স্টিমুলেশন বন্ধ করে দিলাম।
গজনফর আলীর স্ত্রী কেমন জানি ভ্যাবাচেকা মেরে সোফায় বসে রইলেন। একবার আমার দিকে তাকান, একবার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর যন্ত্রের দিকে, আরেকবার তার স্বামী। গজনফর আলীর দিকে তাকান। অনেকক্ষণ পর ফিসফিস করে বললেন, কী আশ্চর্য! কী আচানক ব্যাপার!
আমি তখন মোটামুটি যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করে গজনফর আলীর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখেছেন? এটার নাম হচ্ছে ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর। সায়রা যেসব জিনিস মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিল, সেগুলি মুখস্থ বলতে শুরু করলাম। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট জায়গায় উচ্চ কম্পনের চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে এটার স্টিমুলেশন দেওয়া হয়। স্টিমুলেশন দিয়ে একেক রকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলা যায়। যেমন মনে করেন
গজনফর আলী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা কে তৈরি করেছে?
একজন মহিলা সায়েন্টিস্ট তার নাম হচ্ছে সায়রা সায়েন্টিস্ট।
গজনফর আলী খুব তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে আর যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী কী অনুভূতি তৈরি করা যায়?