আমি বললাম, কে জানে, হয়তো খানিকটা সিদ্ধ হয়েছে।
সায়রা উদাস মুখে বলল, হয়তো হয়েছে। আপনি যখন থুথুড়ে বুড়ো হবেন তখন বোঝা যাবে। ততদিনে সেটা তো আর খবর থাকবে না!
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি যাই বলেন না কেন–আমার মনে হয় এটা গরম। একটা খবর হতে পারে।
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের খবর, খবরের কাগজে ছাপানোর কথা -সেটা ছাপানোর কথা জার্নালে!
কথাটা আমার একেবারেই পছন্দ হল না, ছোট ছোট টাইপে লেখা খটমটে বিজ্ঞানের ভাষায় লেখা জিনিস জার্নালে ছাপা হলেই কি, আর না হলেই কি? জার্নালে ছাপালে নিশ্চয়ই আমার ছবি ছাপা হবে না। আমি বললাম, জার্নালে-ফার্নালে না, এটা খবরের কাগজেই ছাপাতে হবে, তার সাথে টেলিভিশনে একটা সাক্ষাৎকার।
আমি খুব একটা হাস্যকর কথা বলেছি-সেরকম ভান করে সায়রা হি হি করে হাসতে শুরু করল।
আমি অবশ্য হাল ছাড়লাম না, পরদিন কাজে লেগে গেলাম।
.
প্রথমে যে খবরের কাগজের সম্পাদক আমার সাথে দেখা করতে রাজি হলেন তাকে দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম মাথায় বিশাল পাগড়ি এবং প্রায় দেড়ফুট লম্বা দাড়ি। দাড়ি একসময় সাদা ছিল, এখন মেহেদি দিয়ে টকটকে লাল। আমি যখন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে শুরু করলাম, ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কী বললেন? মহিলা সায়েন্টিস্ট? নাউজুবিল্লাহ!
আমি বললাম, নাউজুবিল্লাহ কেন হবে? মেয়েরা কি সায়েন্টিস্ট হতে পারে না? হাদিসে আছে-
পুরুষ এবং মহিলার পড়াশোনা নিয়ে হাদিসটা সম্পাদক সাহেব শুনতে রাজি হলেন না। বললেন, আমাদের পত্রিকা চলে মিডলইস্টের টাকাতে। সেই দেশের মেয়েরা ভোট দিতে পারে না-আর আমি লিখব মহিলা সায়েন্টিষ্টের কথা? আমার রুটিরুজি বন্ধ করে দেব? আমার মাথা খারাপ হয়েছে?
কাজেই আমাকে অন্য একটি পত্রিকা অফিসে যেতে হল। সম্পাদক সাহেব আমার সব কথা শুনে অনেকক্ষণ সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কোন পার্টি?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কোন পার্টি মানে?
মানে কোন পার্টি করে? আমাদের এইটা পার্টির পত্রিকা। আমাদের পার্টি না হলে ছাপানো যাবে না।
কিন্তু সে তো পার্টি করে না।
গুড! আজকেই তা হলে পার্টির মেম্বার হয়ে যেতে বলুন। মহিলা শাখা আছে, তাদের মিটিং-মিছিলে যেতে হবে কিন্তু
সম্পাদক সাহেব আরো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আমার আর শোনার সাহস হল না। তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
এর পরের পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করার জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করতে হল। শেষ পর্যন্ত যখন দেখা হল, ভদ্রলোক আমার কথা শোনার সময় সারাক্ষণ একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটতে লাগলেন। আমার কথা শেষ হবার পর বললেন, ভালো একটা নিউজ হতে পারে।
আমি উৎসাহ পেয়ে বললাম, আরো অনেক আবিষ্কার আছে। সব শুনলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।
সম্পাদক সাহেব আরেকটা ম্যাচের কাঠি বের করে কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন, তবে আমাদের পত্রিকা তো ট্যাবলয়েড, আমরা একটু রগরগে জিনিস ছাপাতে পছন্দ করি। পাবলিক ভালো খায়, পত্রিকা বেশি বিক্রি হয়।
রগরগে?
হ্যাঁ। নিউজটা ইন্টারেস্টিং করার জন্য খবরটা একটু রগরগে করতে হবে। কিছু স্ক্যান্ডাল ঢোকাতে হবে।
আমি অবাক হয়ে মুখ হাঁ করে বললাম, স্ক্যান্ডাল?
হ্যাঁ। খুঁজলেই পাওয়া যায়। ভদ্রলোক কান চুলকানো বন্ধ করে খুব মনযোগ দিয়ে ম্যাচের কাঠিটা পর্যবেক্ষণ করে বললেন, আর না থাকলে ক্ষতি কী? আমরা বানিয়ে বসিয়ে দেব। পাবলিক কপ কপ করে খাবে।
পত্রিকার খবর আমি এতদিন পড়ার জিনিস বলে জানতাম, এখানে এসে শুনছি সেটা খাবার জিনিস। আরো নতুন জিনিস শেখার একটা সুযোগ ছিল কিন্তু স্ক্যান্ডাল বানানো নিয়ে সম্পাদক সাহেবের উৎসাহ দেথে আমার আর থাকার সাহস হল না। বিদায় না নিয়েই সরে এলাম।
এর পরে অনেক খোঁজখবর করে যে পত্রিকা অফিসে গেলাম সেটার নাম দৈনিক মোমের আলো। এই পত্রিকায় আমার একটা চিঠি ছাপা হয়েছিল বলে আমার ধারণা পত্রিকার ওপর আমার একটু দাবিও আছে। সম্পাদক সাহেব খুব ব্যস্ত আমি কথা শুরু করতেই বললেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ওপর খবর?
হ্যাঁ। খুব সাংঘাতিক আবিষ্কার
সম্পাদক সাহেব হা হা করে হেসে বললেন, আমি তো বিজ্ঞানের ব-ও জানি না, তাই আবিষ্কারের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝব না। তবে
তবে কী?
আমাদের বিজ্ঞানের পাতা দেখার জন্য আমরা ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ রাখি। সেই প্রফেসর সাহেব এইসব ব্যাপারগুলো দেখে দেন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি আগে এই প্রফেসরের সাথে দেখা করেন।
কী নাম প্রফেসরের?
এস প্রফেসর এম. জি. আলী।
আমি প্রফেসর এম. জি, আলীর বাসার ঠিকানা নিয়ে এলাম–তার ভালো নাম মোল্লা গজনফর আলী। ইউনিভার্সিটির মাস্টার কিন্তু মনে হল ঢাকা শহরের সব স্কুল-কলেজ-ট্রেনিং সেন্টারে পড়ান। অনেক কষ্ট করে তাকে একদিন টেলিফোনে ধরতে পারলাম। কী জন্য ফোন করেছি বলার পর গজনফর আলী বললেন, বুঝতেই পারছেন, মোমের আলো এত বড় একটা পত্রিকা তো আর সোজা ব্যাপার না, ইচ্ছা করলেই তো সেখানে কিছু ছাপানো যায় না। আমার কথায় কাজ হয়
আমি বিনয় করে বললাম, সেই জন্যই তো আপনার কাছে ফোন করেছি।
গজনফর আলী বললেন, ফোনে কি আর কাজ হয়? পত্রিকায় ছাপা হলে ন্যাশনাল ব্যাপার হয়ে যায়। বিজনেস কমিউনিটি ইন্টারেস্ট দেখায়-লাখ লাখ টাকার ট্রানজেকশন হতে পারে-হে হে হে-