ছবি, কবিতা এবং গানের কাছাকাছি জায়গায় আমার অঙ্কের এলাকাটা পাওয়া গেল। সেখানে স্টিমুলেশন দিতেই আমি জীবনের এই প্রথমবার বুঝতে পারলাম যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ মিলিয়ে বিদঘুটে এবং জটিল অঙ্ককে কেন সরল অঙ্ক বলে! শুধু তাই না, বানরের তেল মাখানো একটা বাঁশ বেয়ে ওঠা এবং পিছলে পড়ার একটা অঙ্ক আছে যেটা আমি আগে কখনোই বুঝতে পারি নি–সেই অঙ্কটা হঠাৎ করে আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার মস্তিষ্কের এই জায়গায় ভালোমতো স্টিমুলেশন দিলে আমি নিশ্চয়ই ল. সা. গু. গ. সা. গু. ব্যাপারটাও বুঝে ফেলতাম কিন্তু সায়ার তার আর চেষ্টা করল না।
মস্তিষ্কের এরকম মজার মজার জায়গা খুঁজে বের করার সাথে সাথে কিছু বিপজ্জনক জায়গাও বের হল। তালুর কাছাকাছি একটা জায়গায় স্টিমুলেশন দিতেই আমি হঠাৎ করে এত ভয় পেয়ে গেলাম যে আর সেটা বলার মতো নয়। সায়রার ল্যাবরেটরিটিকে মনে হতে লাগল একটা অন্ধকার গুহা, সায়রাকে মনে হতে লাগল একটা পিশাচী। তার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। মনে হতে লাগল, সে বুঝি এক্ষুনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলার রগ কামড় দিয়ে সব রক্ত শুষে খেয়ে ফেলবে। ভয় পেয়ে আমি যা একটা চিৎকার। দিয়েছিলাম সেটা আর বলার মতো নয়। ব্যাপারটা টের পেয়ে সায়রা সাথে সাথে পাওয়ার বন্ধ করে আমার জান বাঁচিয়েছে।
মাথার সামনের দিকে একটা অংশে স্টিমুলেশন দিতেই আমি কেমন জানি অসৎ হয়ে গেলাম। গালকাটা বক্কর, তালুছোলা ফাক্ এরকম সব সন্ত্রাসী, পাজি সাংসদ আর অসৎ মন্ত্রীদের কেমন জানি নিজের মানুষ বলে মনে হতে লাগল! সায়রাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে কীভাবে তার বাসার সবকিছু খালি করে নিয়ে ধোলাইখালে বিক্রি করে দেওয়া যায় তার একটা পরিষ্কার পরিকল্পনা আমার মাথায় চলে এল। শুধু তাই না, আমার মনে হতে লাগল খামকা কাজকর্ম করে সময় নষ্ট না করে একটা ব্যাংক ডাকাতি করলে মন্দ হয় না। কোথা থেকে সস্তায় সেজন্য অস্ত্র কেনা যাবে সেই ব্যাপারটাও মাথার মাঝে চলে এল। এতদিন কেন। চুরিচামারি করি নি-সেটা ভেবে কেমন যেন দুঃখ দুঃখ লাগতে লাগল। আরো বেশি সময় স্টিমুলেশন দিলে কী হত কে জানে, কিন্তু সায়রা হ্যান্ডেল টেনে পাওয়ার কমিয়ে আনল।
তবে আমার মস্তিষ্কের সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গাটা ছিল মাথার তালু থেকে একটু ডানদিকে। সায়রা যখন আমার এই জায়গাটা বের করে স্টিমুলেশন দিয়েছে তখন হঠাৎ করে। আমার কেমন জানি রাগ উঠতে থাকে। কেন ফ্যানটা ঘুরছে সেটা নিয়ে রাগ, কেন আমি ডেন্টিষ্টের চেয়ারের মতো চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছি সেটা নিয়ে রাগ, কেন মাথায় হেলমেটের মতো এই জিনিসটা সেটা নিয়ে রাগ, সায়রা কেন যন্ত্রপাতির সামনে বসে আছে সেটা নিয়ে রাগ। শুধু তাই নয়-হঠাৎ করে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল আর আমি সেই টিকটিকির ওপরে এমন রেগে উঠলাম যে বলার মতো নয়। আমি যে রেগে উঠেছি সায়রা সেটা বুঝতে পারে নি। সে হ্যান্ডেল টেনে পাওয়ারটা একটু বাড়িয়ে দিল। সাথে সাথে আমি রাগে একেবারে অন্ধ হয়ে গেলাম। কী করছি বুঝতে না পেরে আমি আঁ আঁ করে চিৎকার করে সায়রার গলা টিপে ধরার জন্য ছুটে গেলাম। ভাগ্যিস সায়রা হ্যান্ডেল টেনে পাওয়ার কমিয়ে দিল, তা না হলে কী যে হত চিন্তা করেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়! কে জানে হয়তো খুনের দায়ে বাকি জীবনটা জেলখানাতেই কাটাতে হত!
যাই হোক শেষ পর্যন্ত মাসখানেক পরে যন্ত্রটা যখন শেষ হল সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটা বাক্সের মতো জিনিসে সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স, সেখান থেকে একটা মোটা তার গিয়েছে লাল রঙের একটা হেলমেটে। হেলমেটটা মাথায় দিলে খুব হালকা টুংটাং একটা বাজনা শোনা যায়। এই যন্ত্রটা কন্ট্রোল করার জন্য টিভির রিমোট কন্ট্রোলের মতো একটা জিনিস, সেখানে লেখা আছে, হাসি, রাগ, ভালবাসা, কবিত্ব ভাব এই ধরনের কথাবার্তা। নির্দিষ্ট সুইচটা টিপে ধরলেই হেলমেট পরা মানুষের মাথায় সেই অনুভূতিগুলো আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে বের করা হয়েছে চিন্তা করেই গর্বে আমার বুক দশ হাত ফুলে উঠতে লাগল।
সবকিছু দেখে আমি সায়রাকে বললাম, এই আবিষ্কারের কথাটা খবরের কাগজে দিতে হবে।
খবরের কাগজে?
হ্যাঁ। আমি একগাল হেসে বললাম, বড় করে একটা রঙিন ছবি থাকবে। আমি হেলমেট পরে হাসিমুখে বসে আছি, পাশে আপনি যন্ত্রের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে ব্যানার হেডলাইন-
বাঙালি মহিলার যুগান্তকারী আবিষ্কার–
মানুষের অনুভূতি এখন হাতের মুঠোয়।
সায়রা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি এতটুকু নিরুৎসাহিত না হয়ে বললাম, ভেতরে লেখা থাকবে, বাঙালি মহিলার যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে এখন মানুষের অনুভূতি হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে তার অন্যতম সহযোগী বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, নিস্বার্থ, জনদরদি, সাহসী, অকুতোভয়, স্বেচ্ছাসেবক মুহম্মদ জাফর ইকবাল!
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, আপনার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। খবরের কাগজের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই-এইসব খবর ছাপবে! এক্সপেরিমেন্ট করার সময় যদি কোনোভাবে আপনার ব্রেন সিদ্ধ হয়ে যেত তা হলে হয়তো ছাপাত!।