সায়রার রাগ হয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা এত মজার যে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল। আমি দেখলাম সার্কাসের জোকারদের মতো সে তার যন্ত্রের হ্যান্ডেলটা টেনে ধরে স্টিমুলেটরের পাওয়ার বন্ধ করে দিল। মুহূর্তে আমার সমস্ত হাসি থেমে গেল। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম-মানুষ কত বড় গাধা হলে আমার মতন এরকমভাবে বোকার মতো। হাসতে পারে? শুধু কি হাসি-নির্বোধের মতো সায়রার চেহারা নিয়ে কী সব বলেছি? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি ফ্যালফ্যাল করে সায়রার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সায়রা আমার কাছে এসে আমার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, আপনাকে এখানে আসতে বলাটাই আমার অন্যায় হয়েছে। শুধু বলবেন আপনার স্বাদের অনুভূতিটি কী, ঝাল না মিষ্টি, টক না তেতো, কিন্তু তা না করে আমার চেহারা নিয়ে টিটকারি মারতে লাগলেন।
আমার লজ্জায় মাথা কাটা যেতে লাগল। আমি কেমন করে এরকম আজেবাজে কথা বলতে পারলাম? সায়রার নাক তো এমন কিছু চ্যাপ্টা নয়, চোখগুলোও বেশ সুন্দর। অথচ একটু আগে একেবারে গাধার মতো সেগুলো নিয়ে হাসাহাসি করেছি। কী লজ্জা! কী। লজ্জা!
লজ্জার ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটা আমার পরিষ্কার হয়ে গেল। সায়রার এই যন্ত্র স্টিমুলেশন দিয়ে ঝাল মিষ্টি স্বাদ নয়-আমার হাসির ব্যাপারটা বের করে এনেছে। কী আশ্চর্য! এই সহজ জিনিসটা আমি বুঝতে পারছি না, সায়রাও বুঝতে পারে নি। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, সায়রা!
সায়রা একেবারে আইসক্রিমের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, বলুন।
আপনি বুঝতে পেরেছেন, কী হয়েছে?
হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। আমার নাকের ওপর দিয়ে দেড়টনি ট্রাক চলে গেছে। আমার চোখগুলো ইঁদুরের মতো কুতকুতে আর আমার থুতনিতে একগোছা ছাগল দাড়ির খুব দরকার।
না না, না না। আমি প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললাম, আপনার এই যন্ত্র এটা করেছে। আমাকে হাসাতে শুরু করেছে। তুচ্ছ কারণে হাসি। অকারণে হাসি। পাগলের মতো হাসি!
সায়রা খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সত্যি বলছেন? আপনি আমার সাথে কোনো ধরনের মশকরা করছেন না?
আপনার সঙ্গে কেন আমি মশকরা করব? সত্যিই এটা হয়েছে।
ধীরে ধীরে হঠাৎ করে সায়রার মুখ একেবারে টিউবলাইটের মতো জ্বলে উঠল, চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর দিয়ে মানুষের সবরকম অনুভূতি তৈরি করে দিতে পারব। হাসি কান্না রাগ ভালবাসা
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, সুখ দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা।
সায়রা বলল, ন্যায় এবং অন্যায়। সৎ এবং অসৎ।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সত্যি? সৎ মানুষকে অসৎ অসৎ মানুষকে সৎ বানাতে পারবেন?
সায়রা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, অবশ্যই পারব। অবশ্যই!
আমি ভেবেছিলাম সায়রা একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে, কিন্তু সে যে সত্যি কথা বলছে। সেটা কয়দিন পরেই আমি টের পেয়েছিলাম।
.
পরের একমাস আমি সায়রার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলাম। আমি হচ্ছি তার গিনিপিগ, আমি যদি যোগাযোগ না রাখি কেমন করে হবে? অনেক সময় নিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে সে আমার মস্তিষ্কের সবকিছু বের করে ফলল। যেমন আমার মস্তিষ্কের একটা জায়গা আছে, সেখানে স্টিমুলেশন দিলে কেমন জানি কান্না পেতে থাকে। তখন আমার সারা জীবনের সব দুঃখের কথাগুলো মনে পড়ে গেল, সেই ছোটবেলায় একটা ফুলদানি ভেঙেছিলাম বলে আমার মা কানে ধরে একটা চড় মেরেছিলেন, সেই কথাটা মনে পড়ে বুকটা প্রায় ভেঙে যাবার মতো অবস্থা হল। পাওয়ার একটু বাড়িয়ে দিতেই আমি এত বড় ধাড়ি মানুষ ভেউভেউ করে কেঁদে ফেললাম-জিনিসটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপার, তা না হলে তো লজ্জাতেই মাথা কাটা যেত! কান্না পাবার অংশের কাছাকাছি আর একটা জায়গাতে স্টিমুলেশন দিতেই বুকের ভেতরে কেমন যেন ভালবাসার জন্ম হয়। বিল্টুর জন্য ভালবাসা, অফিসের বড় সাহেবের জন্য ভালবাসা, সায়রার জন্য ভালবাসা, এমনকি গত রাতে মশারির ভেতরে ঢুকে পড়া যে বেয়াদব মশাটাকে রাত দুটোর সময় মারতে হয়েছিল সেটার জন্যও কেমন যেন ভালবাসা এবং মায়া হতে থাকে।
অনুভূতির এইসব জটিল জায়গা থেকে সরে যাবার পর সায়রা আমার মস্তিষ্কের সৃজনশীল জায়গাগুলো বের করে ফেলল। সেখানে এক জায়গায় স্টিমুলেশন দিতেই আমার ভেতরে একটা চিত্রশিল্পীর জন্ম হয়ে গেল। কাগজে একটা ছবি আঁকার জন্য হাত নিশপিশ করতে শুরু করল। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে একবার চিত্রপ্রদর্শনীতে গিয়ে যে আধুনিক পেইন্টিংগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি নি হঠাৎ করে সেটার অন্তর্নিহিত অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মস্তিষ্কের এই এলাকার কাছাকাছি নিশ্চয়ই কবিতা লেখার ব্যাপারটি আছে, সেখানে স্টিমুলেশন দিতেই আমার মাথার মাঝে কবিতা গুড়গুড় করতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, আমি সায়রার দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু মৃদু হাসি নিয়ে বললাম-
হে সায়রা
তোমার আবিষ্কার যেন আকাশের পায়রা
.
আমার নিজেকে একেবারে কবি কবি মনে হতে লাগল। দাড়ি না কামিয়ে চুল লম্বা। করার জন্য হঠাৎ করে ভেতর থেকে কেমন যেন চাপ অনুভব করতে থাকলাম।
মস্তিষ্কের মাঝে কবিতার এলাকার খুব পাশেই নিশ্চয়ই গানের এলাকা। সেখানে স্টিমুলেশন দিতেই আমার গান গাইবার জন্য গলা খুশখুশ করতে লাগল। বেসুরো গান নয়, একেবারে তাল-লয়-ছন্দ মিলিয়ে গান। গুনগুন করে দুই লাইন গেয়েও ফেলেছিলাম কিন্তু তার আগেই সায়রা মাথার মাঝে জায়গা পাল্টে দিল।