কিন্তু তার আগেই সায়রা হ্যান্ডেলটা টেনে ধরেছে এবং হঠাৎ করে আমার সমস্ত রাগ কেমন করে জানি উবে গেল। শুধু যে রাগ অদৃশ্য হয়ে গেল তাই নয়, আমার হঠাৎ করে কেন জানি হাসি পেতে শুরু করল। আমি সায়রার দিকে তাকালাম এবং তার চেহারাটা এত। হাস্যকর মনে হতে লাগল যে আমি আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না, হঠাৎ খিকখিক করে হেসে ফেললাম।
সায়রা ভুরু কুঁচকে বলল, কী হল, আপনি হাসছেন কেন?
না, না এমনি।
এখন একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে-এর মাঝে যদি হাসি-তামাশা করেন তা হলে কাজ করব কেমন করে?
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আর হাসব না- বলেও আমি আবার হেসে ফেললাম, হাসতে হাসতে বললাম, আসলে আপনি একটু সরে দাঁড়ান। আপনাকে দেখলেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।
সায়রা চোখ পাকিয়ে বলল, কী বললেন আপনি? আমাকে দেখলেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, আপনার চেহারাটা-হি হি হি-
সায়রা বেজার মুখ করে বলল, কী হয়েছে আমার চেহারায়?
আয়নাতে কখনো দেখেন নি? মনে হয় নাকটা কেউ অন্য জায়গা থেকে তুলে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে! আমি হাসি থামাতে পারি না, হি হি করে হাসতেই থাকি।
সায়রা থমথমে গলায় বলল, সুপার গ্লু দিয়ে?
আমি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললাম, হ্যাঁ। সুপার গ্লু দিয়ে লাগানোর পর মনে হয় দেড়টনি একটা ট্রাক আপনার নাকের ওপর দিয়ে চলে গেছে। পুরো নাকটা ফ্ল্যাট, চ্যাপ্টা এবং ধ্যাবড়া। হি হি হি।
সায়রা খানিকক্ষণ আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, দেখেন জাফর ইকবাল সাহেব, আমার ধারণা ছিল আপনি খুব বুদ্ধিমান মানুষ হলেও মোটামুটি একজন ভদ্র মানুষ। আমার সাথে ভদ্রতাটুকু বজায় রাখবেন। আপনি আমার চেহারা নিয়ে হাসাহাসি করবেন সেটা আমি কখনোই আন্দাজ করতে পারি নি।
আমি অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললাম, আই অ্যাম সরি, সায়রা। আমার অন্যায় হয়েছে এই যে আমি মুখে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম, আর আমি হাসব না।
হ্যাঁ, শুধু শুধু ফ্যাক ফ্যাক করে হাসবেন না। আপনার ব্রেনে এখন দশ ডিবি পাওয়ার যাচ্ছে। এটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছি, আপনার কী অনুভূতি হয় বলবেন। ঠিক আছে?
সায়রার মাষ্টারনীর মতো কথা বলার ভঙ্গি দেখে হাসিতে আমার পেট ভুটভুট করছিল, কিন্তু আমি অনেক কষ্ট করে হাসি আটকে রেখে বললাম, ঠিক আছে।
সায়রা হ্যান্ডেলটা টেনে বলল, দশ থেকে বাড়িয়ে চৌদ্দ ডিবি করে দিলাম।
সাথে সাথে আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
সায়রা রেগে গিয়ে বলল, কী হল? আপনাকে বললাম হাসবেন না-শুধু বলবেন কেমন লাগছে। আবার আপনি হাসছেন?
হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি এসে গেল, কোনোমতে নিজেকে থামাতে পারছি না। সায়রা ধমক দিয়ে বলল, কেন আপনি হাসছেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, হি হি হি-আপনার চোখ!
আমার চোখ?
হ্যাঁ, মনে হয় ইঁদুরের চোখ। কুতকুত করে তাকিয়ে আছেন। হি হি হি।
সায়রা কঠিন মুখ করে বলল, আমি কুতকুত করে তাকিয়ে আছি?
হ্যাঁ। আমি কোনোমতে হাসি আঁটকে বললাম, আপনার চোখ দেখলে কী মনে হয় জানেন?
কী?
কেউ যেন দুইটা তরমুজের বিচি লাগিয়ে দিয়েছে। কালো কালো দুইটা বিচি। হি হি হি
সায়রার মুখ এবারে রাগে লাল হয়ে গেল এবং তখন তাকে দেখে আমার হঠাৎ করে পাকা টম্যাটোর কথা মনে পড়ে গেল। আমি অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে রাখলাম। সায়রা পাথরের মতো মুখ করে বলল, আপনাকে নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে জাফর ইকবাল সাহেব। আপনি কোনোরকম সাহায্য তো করছেনই না শুধু আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছেন।
আর করব না। আর করব না সায়রা। খোদার কসম। হাত দুটো খোলা থাকলে দুই হাত জোড় করে আপনার কাছ থেকে মাফ চাইতাম।
ঠিক আছে। এবারে একটু মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আপনার অনুভূতিটি কী বোঝার চেষ্টা করে আমাকে বলার চেষ্টা করুন। বুঝেছেন কী বলেছি?
বুঝেছি। একেবারে জলবৎ তরলং।
এইবারে পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দিচ্ছি। চৌদ্দ ডিবি থেকে বাড়িয়ে একেবারে বিশ ডিবি। কেমন লাগছে এখন?
আমি কোনো কথা না বলে অনেক কষ্ট করে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল, সায়রার থুতনিতে যদি ছাগলের মতো একগোছ দাড়ি থাকত তা হলে কী হত? ব্যাপারটা মাথা থেকে যতই সরিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন তাতে যেন কোনো লাভ হল না-দৃশ্যটা বারবার আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল এবং আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ করে হাসিতে গড়িয়ে পড়লাম। সায়রার চোখ দিয়ে এবারে একেবারে আগুন বের হতে লাগল-সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এবারে আমার কোন জিনিসটা দেখে হাসছেন?
আমি হাসি থামিয়ে বললাম, সেটা শুনলে আপনিও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবেন।
তাই নাকি? সায়রা ঠাণ্ডা গলায় বলল, শুনি ব্যাপারটা।
আপনার থুতনিতে যদি ছাগলের মতো একটু দাড়ি থাকত তা হলে কী কাণ্ড হত চিন্তা করতে পারেন? এরকম হাসির একটা ব্যাপার শুনেও সায়রা একটুও হাসল না–কিন্তু আমি হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলাম।
সায়রা খানিকক্ষণ আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ! আপনি যদি ঠিক করে থাকেন আমাকে সাহায্য করবেন না তা হলে তাই হোক। আপনি যদি আপনার অনুভূতিটা বলতে না চান তা হলে বলবেন না। সায়রার নাকের পাটা ফুলে উঠল, চোখ থেকে আগুন বের হতে লাগল, দাতে দাঁত ঘষে বলল, আপনাদের মতো মানুষের সাহায্য ছাড়াই আমি আমার রিসার্চ চালিয়ে যাব। আমি আমার স্টিমুলেটর বন্ধ করে দিচ্ছি আপনি আপনার বাসায় যান।