কী ভাবছি?
আপনি ভাবছেন এই মেয়েটা নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলছে। মেয়েরা কি আবার কখনো সায়েন্টিস্ট হতে পারে? সায়েন্টিস্ট হবে ছেলেরা। তাদের মাথায় হবে উসকোখুসকো চুল, তাদের থাকবে কাঁচা-পাকা বড় বড় গোঁফ। তারা হবে আপনভোলা। তাদের চোখে থাকবে বড় বড় চশমা, তারা ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া করবে না, ভুশভুশে কাপড় পরে উদাস উদাস চোখে তারা ঘুরে বেড়াবে। ঠিক বলেছি কি না?
আমি বললাম, না, মানে ইয়ে-বলছিলাম কী-মানে ইয়ে
ঠিক তখন পাশে একটা শোরগোল শুরু হল, দেখলাম একজন লিকলিকে শুকনো মানুষ একজন ইয়া মুশকো জোয়ান মানুষের কলার ধরে রিকশা থেকে টেনে নামিয়ে আনছে, দুইজনই চিৎকার করে হাত-পা নাড়ছে যেন পারলে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলবে। খ্যাপা টাইপের মেয়েটি তার হাতের যন্ত্রটি সেদিকে উঁচু করে ধরল এবং আমি দেখতে পেলাম শোরগোল শুনে মেয়েটির চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে শুরু করেছে। তার ভেতরে সে আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, কিন্তু আপনি ভুল। ভুল ভুল ভুল। ছেলেরা যে কাজ পারে মেয়েরাও সেই কাজ পারে। বরং আরো ভালো করে পারে। মেয়েরা প্রাইম মিনিস্টার হতে পারে, ডাকাতও হতে পারে। মেয়েরা হাউজ ওয়াইফ হতে পারে আবার পকেটমারও হতে পারে। ডাক্তারও হতে পারে মার্ডারারও হতে পারে। এস্ট্রোনট হতে পারে, সন্ত্রাসীও হতে পারে। মেয়েরা স্টুপিড হতে পারে আবার সায়েন্টিস্টও হতে পারে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখেন
বলে মেয়েটা তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার তার যন্ত্রের দিকে তাকাল। পাশে শোরগোল তখন আরো জমে উঠেছে, মানুষ দুইজন তখন হাতাহাতি প্রায় শুরু করে দিয়েছে, তাদের ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে উঠেছে। মেয়েটা তার মাঝে ঠেলেঠুলে তার যন্ত্র নিয়ে ঢুকে গেল, মনে হয় যখন কেউ মারামারি শুরু করে তখন তাদের গলার স্বরে কী রকম ওভারটোন হয় সেটা ফিল্ড টেস্ট করতে চায়।
মানুষের ভিড়ের সাথে মিশে গিয়ে মেয়েটা যখন চলে গেল তখন আমি তার কার্ডটার দিকে তাকালাম। ভেবেছিলাম সেখানে তার নাম ঠিকানা টেলিফোন এইসব থাকবে কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেখানে কিছু ইংরেজি অক্ষর লেখা। অনেকগুলো ডাব্লিউ, অনেকগুলো ফুলস্টপ এবং পড়তে গেলে দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা। এটা কি কোনো সাংকেতিক নাম-ঠিকানা আমার যেটা রহস্যভেদ করতে হবে? মেয়েটা কি আমার বুদ্ধি পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে? আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কী করব বুঝতে না পেরে আমি কার্ডটা আমার পকেটে রেখে দিলাম।
.
আমার যখন টাকাপয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় তখন আমি আমার অর্থনীতিবিদ এক বন্ধুর সাথে কথা বলি, যখন রোগশোকের কোনো ব্যাপার হয় তখন কথা বলি এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে, রান্নাবান্না এবং খাওয়াদাওয়া নিয়ে কথা বলতে হলে আমি আমার ছোট খালার সাথে কথা বলি, ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে আমি রাজাকার টাইপের এক মৌলবাদী বন্ধুকে ফোন করি (সে যেটা বলে ধরে নেই তার উল্টোটা হচ্ছে সত্যি) এবং বুদ্ধি সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার থাকলে আমি আমার ভাগ্নে বিল্টুর সাথে কথা বলি। আজকালকার যে কোনো বাচ্চার বুদ্ধি আমাদের থেকে অনেক বেশি আর বিল্টু তাদের মাঝেও এককাঠি সরেস। আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে একবার দেখে বাথরুমে সিংক থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। সে চোখের পলকে মুখ থেকে চিউয়িংগাম বের করে সিংকের ফুটো সেরে দিয়েছিল। দুটো কাগজ ক্লিপ করার জন্য স্ট্যাপলার খুঁজে পাচ্ছি না, সে চিউয়িংগাম দিয়ে দুটো কাগজ লাগিয়ে দিল। একবার তার সমবয়সি একজনের সাথে ঝগড়া হয়েছে তখন পিছন থেকে বিল্টু তার চুলে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিল। চাদির কাছাকাছি প্রায় ছয় ইঞ্চি জায়গা কামিয়ে সেই চিউয়িংগাম সরাতে হয়েছিল। শুধুমাত্র চিউয়িংগাম দিয়েই সে এত কাজ করতে পারে পৃথিবীর অন্য সব জিনিসের কথা ছেড়েই দিলাম। এখন তার বয়স বারো। যখন সে বড় হবে তখন কী কী করবে চিন্তা করেই আমি মাঝে মাঝে আনন্দে এবং বেশিরভাগ সময়ে আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠি।
কাজেই মগবাজারের মোড়ে সেই খ্যাপা মহিলার দেওয়া কার্ডটির কোনো মর্ম উদ্ধার করতে না পেরে আমি একদিন বিল্টুর কাছে হাজির হলাম। সে একটা কম্পিউটারের সামনে বসে বসে কী একটা টাইপ করছে এবং মুচকি মুচকি হাসছে। বিল্টু যখন মুচকি মুচকি হাসে তখন আমি খুব ভয় পাই। তাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে বিল্টু? তুই এরকম ফ্যাকফ্যাক করে হাসছিস কেন?
আরাফাতের কাছে একটা ভাইরাস পাঠালাম। এক নম্বরি ভাইরাস- হার্ড ড্রাইভ ক্র্যাশ করে দিবে।
সে কী বলছে তার কোনো মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারলাম না। শুধুমাত্র তার মুখের হাসিটি দেখে বুঝতে পারলাম কাজটা ভালো হতে পারে না। তাই মুখে মামাসুলভ একটা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, কাজটা ঠিক হল না।
বিল্টু আমার দিকে না তাকিয়ে কম্পিউটারে কিছু একটা টাইপ করতে করতে বলল, তুমি এসব বুঝবে না মামা।
কেন বুঝব না? আমাকে কি গাধা পেয়েছিস নাকি?
বিল্টু আমার কথার উত্তর না দিয়ে কম্পিউটারে টাইপ করতে লাগল, ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট আমাকে সে গাধাই মনে করে। আমি তাকে আর না ঘাঁটিয়ে পকেট থেকে সেই কার্ডটা বের করে তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এইটা কী জানিস?